বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি শাসন করে গেছেন রাজার মত; ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক বাংলার মানুষের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিলেন সবার শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে।
Published : 22 Aug 2017, 01:50 PM
বৈরী আবহাওয়া আর যানজট উপেক্ষা করে মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছিলেন সরকারের মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদরা। এসেছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের সেকাল-একালের সহশিল্পীরা, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধি আর ভক্তরা। সবার হাতে ছিল শ্রদ্ধার ফুল।
বেশ কিছুদিন ধরে নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন ৭৫ বছর বয়সী রাজ্জাক। সোমবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাকে নেওয়া হয় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে। চিকিৎসকরা সন্ধ্যায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পাঁচশর বেশি চলচ্চিত্রের অভিনেতা আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে খ্যাত ছিলেন নায়করাজ নামেই। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাদা কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন তিনি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ২৫ বছর প্রায় একাই টেনে নিয়ে গেছেন এই চিত্রনায়ক। শেষ দিকে অন্য চরিত্রে অভিনয় করলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন তাকে চিরসবুজ নায়ক হিসেবেই দেখে।
সোমবার রাতে রাজ্জাকের মরদেহ রাখা হয় ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে। সেখান থেকে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নেওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে।
সকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি, এরপর প্রখর রোদম কোনো কিছুই দমাতে পারেনি রাজ্জাকভক্তদের; লোকে-লোকারণ্য ছিল বিএফডিসির প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ভেতরের চত্বর পর্যন্ত।
চলচ্চিত্রাঙ্গনের শিল্পী-কলাকুশলীদের পাশাপাশি রাজ্জাককে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ভক্তরারও। সকাল ১১টার দিকে প্রয়াত নায়কের মরদেহ বহনকারী গাড়ির সঙ্গে আসেন তার ছেলে চিত্রনায়ক বাপ্পারাজ ও সম্রাট।
রাজ্জাককে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার, অভিনেতা আলমগীর, চিত্রনায়িকা ববিতা, শাবনূর, নায়ক শাকিব খান, অভিনেতা সুব্রত, আলীরাজ, রুবেল, ফেরদৌস, আহম্মদ শরিফ, ওমর সানি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক নায়ক জায়েদ খানসহ আরও অনেকে।
প্রিয় অভিনেতাকে শ্রদ্ধা জানানোর পর সেখানে তার প্রথম জানাজা হয়।
সেখানে রাজ্জাকের বড় ছেলে বাপ্পারাজ বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
রাজ্জাকের একসময়ের আরেক পর্দাসঙ্গী অভিনেত্রী সুচন্দা বলেন, “রাজ্জাকের নায়কের মতো রূপালী পর্দায় এসেছিলেন। তার চলে যাওয়া নায়কের মতোই হল। তিনি কখনও কারও কাছে কিছু চেয়ে ছোট হননি। রিয়েল লাইফে তিনি মহানায়ক ছিলেন।”
নায়ক আলমগীর বলেন, “আমার বলার কিছুই নাই। পিতা হারালে সন্তানের যেমন লাগে আমারও তেমন লাগছে।”
শাকিব খান বলেন, “এখনকার প্রজন্ম এবং আগামী যত প্রজন্ম আসবে তাদের কাছে নায়করাজ রাজ্জাক প্রেরণা হয়ে থাকবেন। আমরা একজন আইডল হারালাম।”
শাবনূর বলেন, “বিশ্বাস হচ্ছে না রাজ্জাক আঙ্কেল আর নেই। পর্দা থেকে পেছনের নায়ক রাজ্জাক আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”
এফডিসি থেকে বেলা সোয়া ১২টার দিকে রাজ্জাকের মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সেখানে সর্বস্তরের মানুষ নায়করাজের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায়।
রাজ্জাকের কফিনে শ্রদ্ধা জানানোর পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “বাংলা চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তিনি। তার চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এ শূন্যস্থান কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রের উত্তম কুমার।”
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, “রাজ্জাকের নেতৃত্বে এ দেশের চলচ্চিত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি দেশের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। সেই সংস্কৃতির আশ্রয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন।”
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদু্জ্জামান নূর অভিনেতা আবদুর রাজ্জাককে ‘প্রধান স্থপতি’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “বাংলা ছবির নির্মাণের ইতিহাস দেখলে বলতে হয়, যে ব্যক্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা চলচ্চিত্র দাঁড়িয়েছিল তিনি রাজ্জাক। নিজের দক্ষতা, নিজের গুণে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি আমাদের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। আজ বাংলা চলচ্চিত্রের প্রধান স্থপতি চলে গেলেন।”
বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, অভিনেত্রী রোজিনা, চিত্রনায়ক শাকিব খান, চিত্রনায়ক জাভেদ, অভিনেত্রী জয়া আহসান।
শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারা অনেকেই জানালেন তাদের প্রতিক্রিয়া।
অভিনেত্রী রোজিনা বলেন, “আমার জীবনের প্রথম ছবি ‘আয়না’তে নায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম রাজ্জাক ভাইকে। তার সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে তখন আমার হাত-পা কাঁপছিল। সেটা বুঝে তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, ‘তোমার অভিনয় ভালো হচ্ছে।’ অভিনয়ের অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।”
অভিনেত্রী জয়া আহসান বলেন, “ইউনিটে অন্য সবাই যখন দাঁড়াত আর উনি যখন দাঁড়াতেন, তখন ক্লাসিফিকেশনটা খুব ভালো মত বোঝা যেত। উনার বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছু এত মার্জিত ছিল! এরকম পারফেক্ট একটা মানুষকে হিরো হিসেবে দেখি না এখনো। যাবার সময় হলে তো সবাই যায়, কিন্তু আমাদের এখানে তো একটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেলে পূরণ হতে অনেক সময় লাগে, তার চলে যাওয়ায় এই জায়গাটা আর কখনো হয়ত পূরণ হবে না।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও রাজ্জাকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।
নায়ক রাজ্জাক যে বর্তমান প্রজন্মের কাছেও ‘নায়করাজ’ তার প্রমাণ মিলল শহীদ মিনারে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা তরুণদের ভিড় দেখে।
রাজ্জাক ভক্তদের তিনটি সারি শহীদ মিনার থেকে গিয়ে ঠেকে ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগের গেটে। এই লাইনে তরুণদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।
ঢাকা সিটি কলেজের এইচএসসিপড়ুয়া তিন বান্ধবী এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে।
সানিয়া সাফা বলেন, "নায়ক রাজ্জাকের সিনেমার পাগল আমার আম্মা। ইউটিউবে যে কয়টা পাই আম্মাকে ছেড়ে দেই দেখার জন্য, আমি নিজেও দেখি। আম্মা অসুস্থ, তাই আমাকে পাঠিয়েছেন তার পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে যেতে। আমি নিজেও একজন ভক্ত উনার।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার ছাত্র ওয়ালিউল্লাহ নোমান খান ও তার কয়েকজন বন্ধু এসেছিলেন নায়করাজের মৃতদেহ দেখতে আর শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
নোমান বলেন, “ক্যাম্পাসে কত রাত কাটাই নীল আকাশের নিচে গানটা গেয়ে! যখনই গাই নায়ক রাজ্জাকের সুন্দর চেহারাটা আমার চোখে ভাসে। আর রংবাজ ছবিতে তার অভিনয় আর অ্যাপিয়ারেন্স কোনোদিন ভুলব না।"
“আমি তার কমপক্ষে ৬০-৭০টা সিনেমা দেখেছি। প্রতিটা ছবিতে মুগ্ধ করেছেন। তার চোখ দুটো আমার খুব প্রিয়।”
গাড়ী মেরামত কারখানায় কাজ করা সবুজ শিকদার কাজের ফাঁকেই চলে এসেছেন নায়করাজকে শেষবারের মতো দেখতে।
তিনি বলেন, “দেশে থাকতে উনার অশিক্ষিত সিনেমাটা দেখছি। আরো দেখতে মন চাইত। ঢাকায় আইসা ইন্টারনেট শিখার পর অনেক ছবিই দেখছি। এখনকার সবার চাইতে তারেই ভালো লাগে আমার।”
“আমার কাছে মনে হয় সালমান শাহ ছাড়া নায়ক রাজ্জাককে ছাড়িয়ে যাওয়ার মত আর কোনো নায়ক বাংলাদেশে নেই। এত বছর পরও তার ওরা এগার জন, জীবন থেকে নেয়া, রংবাজ, লাইলি মজনু এসব ছবির ধারেকাছে কারো সিনেমা নাই,” বললেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা তরুণ ব্যাংকার রাসেল আহমেদ।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় গুলশানের আজাদ মসজিদে। সেখানে জানাজা শেষে পুনরায় হিমঘরে নেওয়া হয় কফিন। বনানী কবরস্থানে বুধবার সকালে শায়িত হবেন নায়করাজ।
মঙ্গলবার দাফনের কথা থাকলেও পরে পকিল্পনা বদলানো হয় বলে জানান তার ছোট ছেলে অভিনেতা সম্রাট।
তিনি বলেন, তার মেজ ভাই বাপ্পী কানাডা থেকে বুধবার ভোরে ঢাকায় আসবেন। তারপর সকাল ১০টায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
পরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে অভিনেতা আলমগীর বলেন, রাজ্জাকের পছন্দ করা জায়গায় তাকে দাফন করা হবে।
নায়করাজের প্রস্থানের পর