তুরস্কে ভূমিকম্প: মায়ের লাশের সঙ্গে দু’দিন, যেভাবে বেঁচে ফিরল দুই বোন

ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া পাঁচতলা ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মারভি এবং তার বোন ইরেমকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন উদ্ধারকারীরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2023, 03:03 PM
Updated : 12 Feb 2023, 03:03 PM

তুরস্কে ভূমিকম্পের পর পাঁচতলা ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া ২৪ বছর বয়সী মারভি এবং তার ১৯ বছর বয়সী বোন ইরেমকে দু’দিন পর উদ্ধার করা হয়।

তাদেরকে উদ্ধার করতে পেরে উদ্ধারকর্মীরাসহ আশেপাশের সবাই তখন আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছিল, চোখে ছিল আনন্দাশ্রু।

দুই বোন পাশেই তাদের মায়ের মৃতদেহের সঙ্গে আটকা পড়ে থাকার পর যেভাবে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার পেল- সেই কাহিনী সবিস্তারে তুলে ধরেছে বিবিসি:

মারভি! ইরেম! মারভি! ইরেম! উদ্ধারকর্মী মুস্তফা অজৎতুর্ককে চিৎকার করতে শোনা যায়। আশপাশের সবাইকে তখন নীরবতা বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেন মারভি আর ইরেমের আওয়াজ শুনতে পারা যায়।

উদ্ধারকারী দলটি মারভি এবং ইরেমের খোঁজ করছিল, কারণ তাদের বন্ধুরা সেখান থেকে বেঁচে ফিরে বলেছিল, তারা জীবিত অবস্থায় ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে।

ঘটনার দুদিন পর অর্থৎ বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় একটি সংবেদনশীল ডিভাইসের মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপের ভেতরের প্রতিক্রিয়া শোনার চেষ্টা করে উদ্ধারকারী দল। এ সময় সবার ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা বিরাজ করছিল।

হঠাৎ মুস্তফা চিৎকার করে বলেন, “ইরেম! আমি তোমার কাছাকাছি চলে এসেছি। তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছ! হ্যাঁ?”

কেউ কোনও শব্দ শুনতে না পেলেও কিছু সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। আর আটকে পড়া দুই বোনের বন্ধু-বান্ধবদের একটি দলও উদ্ধারকারীদের সঙ্গে নীরবে অপেক্ষা করছিল।

“চমৎকার! তুমি শান্ত থাক আর আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আচ্ছা ঠিক আছে, এইতো মারভি। মারভি, তুমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও,” মুস্তফা বলছিলেন।

ওদিকে, ভূমিকম্পের পর দুদিন পেরোলেও তাদের কাছে মনে হচ্ছিল যেন কয়েক সপ্তাহ। দক্ষিণ তুরস্কের আনতাকিয়া পাঁচতলা ভবনের নিচে আটকে ছিল তারা।

ভেতর থেকে কথা শুনে মুস্তফা বলতে থাকেন, “আজ বুধবার! না, তুমি ১৪ দিন আটকে ছিলে না। আমাদের পাঁচ মিনিট সময় দাও, তোমাদের এখনই বের করে আনা হবে।”

মুস্তফা জানতেন, তাদেরকে উদ্ধার করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। কিন্তু এটাও তিনি জানতেন যে, তাদেরকে আশা দিতে হবে। কারণ, আশা হারালে তাদেরকে বাঁচানো যাবে না।

উদ্ধারকারীদের এমন তৎপরতা শুনতে পেয়ে মারভি আর ইরেমও নিজেদের মধ্যে খুনসুটি শুরু করে। ঠিক এ সময়ই মুস্তফার মুখজুড়েও ফুটে ওঠে হাসি। তিনি বলছিলেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত জায়গা থাকলে এ সময় হয়ত তারা নাচতে শুরু করত।

উদ্ধারকারী দলটির হিসেবে, তাদেরকে প্রায় দুই মিটার বা সাড়ে ছয় ফুটের মতো সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দুই বোনের কাছে পৌঁছতে হবে। কিন্তু এই খোঁড়াখুঁড়িতে ছোট্ট একটি ভুলও অনেক বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, সে বিষয়টিও জানতেন উদ্ধারকারী দলটির কমান্ডার হাসান বিনায়।

এ কারণে গর্ত করার সময় ভবনটি আবার যেন ধসে না পড়ে সেজন্য বুলডোজার দিয়ে আটকে রাখা হয়। ওই সময়ই মুস্তফা আবারও দুই বোনের উদ্দেশে বলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের কম্বল দেওয়া হবে।

ওপাশ থেকে তখন কিছু একটা জবাব পেয়ে মুস্তাফাকে বলতে শোনা যায়, “আরেহ না, আমাদের নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমরা ক্লান্ত নই, আমাদের ঠান্ডাও লাগছে না।”

মুস্তফা বলেন, এমন বিপদের মধ্যে থেকেও উদ্ধারকারী দলের জন্যই চিন্তা করছিল মারভি। কারণ, তখন স্থানীয় সময় ছিল রাত সাড়ে ৮টা। ছিল তীব্র শীত। এ অঞ্চলে এবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল, তা স্থানীয়দের জানাই ছিল। 

উদ্ধারকারীরা সতর্কতার সঙ্গে সুড়ঙ্গ তৈরি করার চেষ্টা করছিল আর ধ্বংসস্তূপের কংক্রিটগুলো নিজেরা খালি হাতে দূরে ছুড়ে ফেলছিল। কিন্তু এর কয়েক ঘণ্টা পর হঠাৎ উদ্ধারকারীরা তাদের পায়ের নিচে কাঁপুনি অনুভব করেন।

সেটি যে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরাঘাত ছিল তা বুঝতে বাকী রইল না উদ্ধারকারী দলটির। তারা বুঝতে পারে যে, অভিযান বন্ধ করে তাদেরকে এখন এখান থেকে চলে যেতে হবে। “এ এক নির্মম বাস্তবতা! আমাদের দলের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতে হবে,” বলেছিলেন কমান্ডার হাসান।

পরাঘাতের আধঘণ্টা পর মুস্তফা ও তার উদ্ধারকারী দল আবার খননের স্থানটিতে যায়। “ভয় পেও না! আমরা তোমাদেরকে এখানে রেখে যাব না। তোমাদেরকে এখান থেকে বের করা হবে, আর তোমরা আমাদের দুপুরে খেতে নিয়ে যাবে,” চিৎকার করে বলেন মুস্তফা।

মারভি আর ইরেম ভেবেছিল, উদ্ধারকারী দলটি হয়ত তাদের মুত্যুমুখে রেখে চলে গেছে। এভাবেই মধ্যরাত হয়ে যায়। খনন কাজ আবার শুরু হয়েছে। হঠাৎ আলো বন্ধ হয়ে গেল, সব অন্ধকার।

দুই বোন মুস্তফার টর্চ থেকে আসা আলো দেখতে পায় কি না, তা দেখার জন্য কংক্রিটে একটি ছোট্ট গর্ত করা হয়। মুস্তফা বলেন, “মারভি! ইরেম! তোমরা কি আলো দেখতে পাচ্ছ? ঠিক আছে। এখন আমি একটি ছোট্ট ক্যামেরা পাঠাচ্ছি। এটি দেখতে পেলে আমাকে জানাও। তোমাদের কী করতে হবে তা আমি বলে দেব।”

এরপরই এল উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত। মারভি ও ইরেম ক্যামেরাটি নিতে পেরেছে। একটি ‘নাইট ভিশন ক্যামেরার’ সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ছোট পর্দায় তাদের দেখা গেল। “চমৎকার! বেশি নড়াচড়া করো না। ইরেম ক্যামেরাটা ঠিক করে ধর, যেন মারভিকে আমরা ভালোভাবে দেখতে পারি,“ বলেন মুস্তফা।

ঠিক এই সময়ে ইরেমকে হাসতে দেখা যায়। ভাগ্যক্রমে সেখানে পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল।

তখনই সবার মধ্যেই এক ধরনের শান্তি ভাব দেখা যায়। তাদেরকে সুস্থ মনে হচ্ছে, এবং সুড়ঙ্গ তৈরি করলে ইরেম নিজেই বের হয়ে আসতে পারবে।

কিন্তু মুহুর্তেই দলটিকে আরও সর্তক হতে দেখা যায়। মারভি বলছে, সে তার পায়ে শীত অনুভব আর ভারি কিছু একটা অনুভব করছে। এ সময়ে চিকিৎসক দলকে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়তে দেখা যায়- “মারভির পায়ে কি গ্যাংগ্রিন আছে? নাকি এটা হাইপোথার্মিয়ার প্রথম লক্ষণ?”

সময় পেরিয়ে তখন ভোর পাঁচটা। তাদের তৈরি করা সুড়ঙ্গ নিচে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্তই মনে হচ্ছে। উদ্ধারকারীরা কিছু সময়ের জন্য ইরেমের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয় এবং মুহুর্তের জন্য ইরেমের হাত স্পর্শ করতে পারেন উদ্ধারকারী দলের একজন।

“আমাদের মায়ের শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসতে শুরু করেছে। আমরা ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছি না”, ইরেম উদ্ধারকারীদের জানায়। দুই বোন তাদের মৃত মায়ের পাশেই এ কয়দিন আটকে ছিল।

হাসান বিনায় মারিভের এক বন্ধুর কাছে তাদের ছবি চায়। সুড়ঙ্গ কতটা চওড়া করতে হবে সেটি অনুমান করার চেষ্টা করছিল উদ্ধারকারী দল। বিষন্ন ও নীরব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকা এক বন্ধু একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দুই বোনের হাস্যজ্জ্বল একটি ছবি দেখায়। “ঠিক আছে, আমরা তাদেরকে উদ্ধার করতে পারব”, বলেন হাসান।

ওদিকে চিকিৎসক দলটিও থার্মাল কম্বল ও স্ট্রেচার নিয়ে প্রস্তুত। সময় সকাল সাড়ে ৬টা, ইরেমকে বের করে আনা হয়েছে। সে একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। “সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুক, মারিভকেও উদ্ধার করুন”, উদ্ধারকারীদের অনুরোধ জানায় ইরেম।

হাসান জবাবে বলেন, “তোমার মতই মারিভকেও উদ্ধার করা হবে। আমি কথা দিচ্ছি।“ এরপর মারভিকে উদ্ধার করতে সময় লাগে আরও আধঘণ্টা। কারণ, কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া মারভির পায়ের কোনও ক্ষতি না করে তাকে উদ্ধার করতে চেয়েছে দলটি। এতে তারা সফলও হয়েছে। 

মারভিকে বের করে নিয়ে আসার পর সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। আর মারভি ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে, তারপর হঠাৎ সে জানতে চায়, “আমি কি বেঁচে আছি?“

মুস্তফা এ সময় হাসতে হাসতে হ্যাঁ সূচক জবাব দেন; বন্ধুরা যারা সারারাত সেখানে ছিল তারা আনন্দে কেঁদে ফেলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। “মারভি! ইরেম! আমরা তোমাদের পাশে আছি। কোনও ভয় নেই।“

এই আনন্দের পরই আবার হঠাৎ সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ আসে উদ্ধারকারী দল থেকে। কেউ জীবিত আছে কি না তা জানতে তারা শেষ চেষ্টা চালায়।

“যদি কেউ আমার কথা শুনে থাক, সাড়া দাও। সাড়া না দিতে পারলে মাটি স্পর্শ করার চেষ্টা কর”, হাসান বিভিন্ন স্থানে একই কথা বলতে থাকেন। কোনো সাড়া না পেয়ে লাল স্প্রে দিয়ে তিনি কংক্রিটের উপর একটি কোড লেখেন, যার অর্থ অন্য উদ্ধারকারী দল ভবনটিতে আর অনুসন্ধান চালাবে না। অর্থাৎ, এখানে আর কিছু নেই।

“মানুষ হিসেবে একজন মানুষকে উদ্ধার করা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু যদি কোনও মৃত্যু না হত তাহলে বেশ ভাল হত,” বলতে বলতে হাসানের চোখে মুখে ফুটে ওঠে বিষণ্নতার ছাপ।

“আপনি কি মারভি ও ইরেমের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাবেন? হাসানকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হেসে বলেন, “একদিন নিশ্চয়ই আমরা খাব। এর চেয়েও ভাল ব্যাপার হল, তারা বেঁচে আছে এবং আপাতত ভাল মানুষদের সঙ্গে রয়েছে।”