জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি ও আর্থিক সংকটে এবছর সরকারগুলো তাদের প্রতিশ্রুতির পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
Published : 11 Nov 2022, 08:17 AM
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গত বছরের নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬-এ যোগ দিয়েছিলেন বিশ্ব নেতারা। সেখানে কার্বন গ্যাস নির্গমন যতটা কমানোর প্রতিশ্রুতি দরকার ছিল, ঠিক ততোটা আসেনি; ক্ষতি কাটাতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থায়নেরও কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়নি।
কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি চুক্তিতে ওই সম্মেলন শেষ হয়েছিল। কিন্তু এক বছর পর তেমন কোনো অগ্রগতি দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি ও আর্থিক সংকটে সরকারগুলো তাদের প্রতিশ্রুতির পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে ২০২২ সালে জলবায়ু প্রশ্নে অগ্রগতি ধীর হয়ে গেছে।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, বিশ্ব বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। তবে আশা দেখাচ্ছে নতুন মার্কিন আইন আর ব্রাজিলে সরকার পরিবর্তন, যা হয়ত অ্যামাজন রেইনফরেস্টের ধ্বংস ঠেকাতে পারবে।
কপ-২৭ সম্মেলনে যোগ দিতে মিশরে যাচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রাখা সাতটি দেশের মধ্যে কারা বিপর্যয় এড়ানোর চেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর কারা পেছন থেকে টেনে ধরছে, সেই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
কার কী দায়?
যুক্তরাষ্ট্র: ফের নেতৃত্বে?
জলবায়ু সঙ্কটের সঙ্গে লড়তে সুদূরপ্রসারী নতুন আইন পাসের মাধ্যমে এ বছর বড় পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে দেওয়া গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ৪০ শতাংশ কমে আসতে পারে।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের মার্কিন পরিচালক ড্যান লাশফ বিবিসিকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে জলবায়ু সঙ্কটের সমাধানে এটি সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। অগ্রগতির একটি বড় লক্ষণ এটা।”
মার্কিন এই আইনের লক্ষ্য বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং শিল্পের মত প্রধান খাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। গ্রাহক পর্যায়ে এর সরসরি ফল মিলবে কর ছাড়ে। কেউ একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনলে করের ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ডলার ছাড় পেতে পারেন তিনি।
কিন্তু সবই ভালো খবর নয়। মার্কিন স্পিকারের বিতর্কিত তাইওয়ান সফরের পর জলবায়ু প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার হাত ফিরিয়ে নিয়েছে চীন। ওই টানাপড়েন জলবায়ু আলোচনায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ন্যায্য অংশও দেয়নি, আর এটা কপ-২৭ সম্মেলনে টানাপড়েন বাড়াতে পারে।
যুক্তরাজ্য: নেতৃত্ব ও ‘বিমুখতা’
কপ-২৬ সম্মেলনের আয়োজক ছিল যুক্তরাজ্য। সেখানে তারা বড় প্রতিশ্রুতি রেখেছে এবং জলবায়ু প্রশ্নে নিজেদের নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখিয়েছে। কিন্তু এবার ব্রিটিশদের সেই স্বতস্ফূর্ততা নেই।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্র্যান্থাম ইনস্টিটিউটের পলিসি ডিরেক্টর অ্যালিসা গিলবার্ট বিবিসিকে বলেন, ‘হতাশাজনক ও দুর্বল’ একটি চেহারা নিয়ে কপ-২৭ সম্মেলনে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।
প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণে’ মিশরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। তবে পরে তিনি মন বদলেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্মেলনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্য আপস করেছে।
“কপ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা। আমরা যখন কপের প্রেসিডেন্ট, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সম্মেলেনে যোগ দেওয়া নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা শোচনীয় একটি অবস্থার কথাই বলে,” বলেন গিলবার্ট।
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জলবায়ু সঙ্কট এড়াতে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি যুক্তরাজ্য দেয়নি। বরং বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে উত্তর সাগরে নতুন করে তেল ও গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করা এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে গেছে দেশটি।
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক রবার্ট ফকনার বলেন, “সিদ্ধান্তের ওই পরিবর্তনগুলো যুক্তরাজ্যের জ্বালানির সমস্যা মেটাতে পারবে না। তবে সেগুলো ভুল বার্তা দেবে।”
রাশিয়ার চাপে ইইউ
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ঐতিহাসিকভাবে প্রগতিশীল; কিন্তু ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং জ্বালানি সরবরাহের সঙ্কট ইইউর সেই ভূমিকায় পরিবর্তন এনেছে।
অধ্যাপক রবার্ট ফকনার বলেন, “ইউরোপীয় নেতারা কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়িয়েছেন এবং আমরা অনুমান করছি, ইউরোপে কার্বন গ্যাসের নির্গমন এ বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।”
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার মনে করছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা, নীতি এবং অর্থায়ন এখন ‘অপ্রতুল’। আর ইইউ তাদের নতুন ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যানের হালনাগাদ অবস্থা জাতিসংঘে এখনও জানায়নি।
তবে অধ্যাপক ফকনার জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ ফিরে আসার বিষয়টিকে একটি ‘সাময়িক ধাক্কা’ বলে মনে করেন। তার পরামর্শ, ইইউ নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করে নিজেকে সুরক্ষিত করার এই সুযোগ নিতে পারে।
‘রি-পাওয়ার ইইউ’ নামের এই নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে ইইউর।
ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বাধা কয়লা
এ বছর যেসব দেশ হালনাগাদ জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করেছে, ভারত তাদের অন্যতম। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের কাম্য চৌধুরী বলছেন, “অগ্রগতির কথা না বলে ভারতের বিষয়ে কথা বলা প্রায় অসম্ভব।”
২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ৪৫ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত; দেশের অর্ধেক জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যোগান দেওয়ার সামর্থ্যে পৌঁছাতে চায় দেশটি।
কিন্তু ভারতের ১০০টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা (সবচেয়ে দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানী) সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনের পথে একটি বিশাল বাধা বলে মনে করেন সেন্টার ফর পাবলিক পলিসি এবং জাতিসংঘের জলবায়ু উপদেষ্টা অধ্যাপক নভরোজ দুবাশ বলেছেন।
তবে অন্য দেশের মত ভারতের ক্ষেত্রেও কয়লায় ফেরাকে সঙ্কট সমাধানের স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে দেখছেন কাম্য চৌধুরী।
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার অবশ্য বলছে, ভারতের জলবায়ু অঙ্গীকারগুলো যতটা বলা হচ্ছে, ততটা উচ্চাভিলাষী আসলে নয়; সরকারের গুটিকয় পদক্ষেপেই সেটা অর্জন করা সম্ভব।
ব্রাজিল: নতুন প্রেসিডেন্ট, নতুন প্রত্যাশা
জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ব্রাজিল। কারণ এই গ্রহের ফুসফুসখ্যাত বিশাল রেইনফরেস্ট অ্যামাজন রয়েছে সেখানে। প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে এই বন।
গত সপ্তাহে এক নাটকীয় নির্বাচনে জাইর বলসোনারোকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন লুলা দা সিলভা। নেতৃত্বের এই পরিবর্তনে অ্যামাজনেরও ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে।
নির্বাচিত হয়েই লুলা বলেছেন, “ব্রাজিল জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার নেতৃত্বের ভূমিকা পুনরায় গ্রহণ করতে প্রস্তুত।”
কেবল ২০২১ সালেই অ্যামাজনে বন উজাড়ের হার বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। এর মূল কারণ ছিল অ্যামাজনে খনিজ সম্পদ উত্তোলনে বলসোনারোর উৎসাহ।
গ্লাসগোর কপ-২৬ সম্মেলনের পর ব্রাজিলের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ওই অঙ্গীকার ২০১৬ সালের প্রতিশ্রুতির চেয়েও পেছনে।
ব্রাজিল প্রচুর পরিমাণে জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে আসছিল, যা পরিবেশবান্ধব। কিন্তু ২০২১ সালের খরায় জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে। ফলে দেশটি তেল-গ্যাস ব্যবহার বাড়িয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রাজিলে তেলের ব্যবহার ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা বলছে, যেসব দেশ জলবিদ্যুত নিয়ে সমস্যায় পড়েছে, সৌরশক্তি তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে।
ফিরে আসার চেষ্টা অস্ট্রেলিয়ার
রাজনীতি অস্ট্রেলিয়ার চেহারাও পাল্টে দিয়েছে। মে মাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন অ্যান্টনি আলবানিজ। গত এক দশকে পিছিয়ে পড়ার পর এখন তিনি আবার জলবায়ু পরিকল্পনাগুলো বাড়াচ্ছেন।
দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কার্বন নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাতিসংঘের কাছে নতুন লক্ষ্য পেশ করেছে। আগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ শতাংশ।
ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের প্রধান নির্বাহী সিইও বিল হেয়ার বলছেন, অনেক পিছিয়ে থাকার কারণেই অস্ট্রেলিয়ার এই অঙ্গীকারকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে মনে হচ্ছে।
“এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার নীতিতে পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই, আর সেটা জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্রেও হয়নি।”
অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়াচ্ছে। তবে এখনও দেশটি বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি কয়লা উৎপাদক দেশের একটি।
অস্ট্রেলিয়া কপ-২৬ সম্মেলনে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; ২০২১ সালে ওই প্রতিশ্রুতি দেওয়া একমাত্র উন্নত দেশ তারা। অস্ট্রেলিয়া গাছ ধ্বংসের জন্য ‘হটস্পট। পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার প্রায় অর্ধেক বন ধ্বংস হয়ে গেছে।
‘ভয়ঙ্কর’ দূষণকারী চীনের নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ
বৈশ্বিক জলবায়ু সঙ্কটে চীনের একটি জটিল ভূমিকা রয়েছে। গ্র্যান্থাম ইনস্টিটিউটের জ্বালানি ও প্রশমন বিভাগের সিনিয়র পলিসি ফেলো নেইল হার্স্ট ব্যাখ্যা করেছেন- উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মত চীন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে দায়ী না হলেও, খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাওয়ার চেষ্টায় ‘ভয়ঙ্কর দূষণকারী’ দেশে পরিণত হয়েছে।
চীন বিশ্বের অর্ধেক কয়লা পোড়ায় এবং জ্বালানি সঙ্কটের কারণে সেটা বন্ধ করতেও নারাজ। তবে হার্স্ট বলেছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চীন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। চীনে নতুন নিবন্ধিত গাড়ির এক চতুর্থাংশ বৈদ্যুতিক।
“তারা বড় ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করছে যে ২০৩০ সালের পর কার্বন নির্গমনের হার তারা আর বাড়তে দেবে না।”
গাছ লাগানোর মাধ্যমেও কার্বন নিঃসরণ মোকাবেলার বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে চীনের। গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ লাখ বিলিয়ন গাছ লাগানোর অঙ্গীকার করেছেন।
আরও খবর
শেষ মুহূর্তে ‘মন্দের ভালো’ চুক্তিতে জলবায়ু সম্মেলনের সমাপ্তি