শেষ মুহূর্তে ‘মন্দের ভালো’ চুক্তিতে জলবায়ু সম্মেলনের সমাপ্তি

যে প্রত্যাশা নিয়ে শুরুটা হয়েছিল, তার অনেক কিছুতেই ঐকমত্য হল না, তবে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে একটি চুক্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শেষ হল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2021, 08:30 PM
Updated : 13 Nov 2021, 09:51 PM

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখতে কার্বন গ্যাসের নির্গমন যতটা কমানো দরকার, ততটা প্রতিশ্রুতি এবারের সম্মেলনে আসেনি। জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় বা জলবায়ুর ক্ষতি পোষাতে অর্থায়নের দাবিতেও শিল্পোন্নত দেশগুলোর কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়নি।      

তবে সম্মেলনের সূচি পেরিয়ে আরও একদিন স্নায়ুক্ষয়ী দর কষাকষি শেষে যে চুক্তি হল, তাকে ‘একেবারেই কোনো ঐকমত্য না হওয়ার চেয়ে ভালো’ বলে মনে করছে দেশগুলো। তাতে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে ধরিত্রীকে বাঁচানোর বাস্তবসম্মত সুযোগ তৈরির আশাটা অন্তত জিইয়ে রাখা গেল।

শুক্রবার নির্ধারিত সময়ে খসড়া চুক্তি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি না হওয়ায় বর্ধিত আলোচনা শেষে শনিবার সন্ধ্যার পর ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়। 

খসড়া চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ভারত। কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রস্তাবে কয়লার ওপর অতিনির্ভর দেশটি। তার সঙ্গে আপত্তি জানিয়েছিল চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া ও ইরানও।

তবে শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত অধিবেশনে ভারত খসড়া চুক্তিতে অব্যাহত কয়লা শক্তি ‘পর্যায়ক্রমে শূণ্যে নামিয়ে আনা’র বদলে ‘পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা’ শব্দগুচ্ছ প্রস্তাব করে।

এ নিয়ে সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হতাশা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়।

এর আগে দুই সপ্তাহের ক্লান্তিকর আলোচনা শেষে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন থেকে ফলাফল না আসায় সময় বাড়িয়ে শনিবারের মধ্যে চুক্তি হওয়ার আশা প্রকাশ করেন কপ-২৬ প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্যের অলোক শর্মা।

সেই আশা সত্যি করতে শনিবার রাতে বড় একটি নোটবুক হাতে নিয়ে তাকে সম্মেলন কেন্দ্রে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়।

তবে এবারের সম্মেলনের এই চুক্তির সাফল্য যে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, বিশ্বকে বাঁচাতে এখন দরকার জরুরি পদক্ষেপ।

রয়টার্স বলছে, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস উপরে আটকে রাখার যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, সম্মেলনের আয়োজক ব্রিটেনের তোলা প্রস্তাব তার কাছাকাছিও যেতে পারেনি।

শনিবার সকালে চুক্তির যে খসড়া সবার হাতে হাতে দেওয়া হয়েছে, তাতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমণ হ্রাসে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ‘যথেষ্টর অনেক কম’ বলে স্বীকারও করা হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, তাকে ‘রাজনৈতিক আপস’ আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। পাঁচ বছরের জন্য অপেক্ষা না করে সামনের বছরই আরও ‘কঠোর’ জলবায়ু প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে সেখানে।

চুক্তির তৃতীয় খসড়ার ওপর শেষ মুহূর্তের আলোচনায় কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি তোলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন নির্গমনকারী দেশ ভারত।

দেশটির পরিবেশমন্ত্রী ভুপিন্দর যাদব বলেন, “জ্বালানির উৎস নিয়ে পরামর্শ দেওয়া জাতিসংঘের কাজ নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো ‘কার্বন বরাদ্দের ন্যায্য হিস্যা চায়’ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ‘দায়িত্বশীল ব্যবহার’ অব্যাহত রাখতে চায়।”

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ২০৬০ সালকে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে, যেখানে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণ প্রয়োজন।

গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিলে চীন নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে প্রস্তাবে আপত্তি জানায়।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা উৎপাদনকারী এ দেশটিতে জ্বালানির প্রধান উৎসও ওই কয়লা। বিশ্বে ব্যবহৃত মোট কয়লার অর্ধেকেরও বেশি চীনেই ব্যবহৃত হয়।

অধিবেশনে জি৭৭ জোট এবং চীনের পাশে অবস্থান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা বলেছে, ‘সবার জন্য এক নীতি কোনো ভাল প্রস্তাব হতে পারে না।’

পরে সেই তালিকায় যোগ দেয় ইরান। অধিবেশনে দেশটির প্রতিনিধি বলেন, “অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। আমরা এ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের অনুরোধ করছি।”

শক্তি তৈরির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হলে বাতাসে মেশে বিভিন্ন কার্বন গ্যাস, এর বেশিরভাগই কার্বন ডাইঅক্সাইড। এসব গ্যাস সূর্যের আলো থেকে তাপ ধরে রাখে। ফলে বাড়তে থাকে পৃথিবীর তাপমাত্রা।

এই বাড়তি তাপমাত্রাই বদলে দিচ্ছে জলবায়ু, এক দিনে বরফ গলে যাচ্ছে, আরেক দিকে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। চরম আবহাওয়া ডেকে আনছে মৃত্যু আর ধ্বংস।  

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে বাড়তি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

সেজন্য কমাতে হবে কার্বন গ্যাস নির্গমণ। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বনেতারাও তাতে একমত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে এ লক্ষ্য অর্জনে বেশিরভাগ দেশ প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল।

লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমানো, আর ২০৫০ সালের মধ্যে মোটামুটি শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা দরকার।

কিন্তু গ্লাসগো সম্মেলনে যত প্রতিশ্রুতি এসেছে তাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রির বেশি হওয়ার পথে এগোবে বলে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার।

উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, ধনী দেশগুলোর তুলনায় কার্বন নিঃসরণ কম করেও তাদেরই ভুগতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়েই এখন বন্যা, খরা ও দাবানলের মতো বিপর্যয়ের দাপট; আর এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছে গরিব দেশগুলো।

তাদের দাবি ছিল, ধনী দেশগুলোকে শুধু কার্বন নির্গমণ কমালেই হবে না, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতির শিকার দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তাও তাদের দেওয়া উচিত।

যে কারণে গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনে কম সম্পদশালী ও ছোট দেশগুলোর চাহিদা পূরণই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার আশা করা হলেও তার গুঁড়ে বালি।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ- ২৬ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। রয়টার্স

জলবায়ু অর্থায়ন

গরিব দেশগুলো যাতে প্রতিশ্রুত আর্থিক সহায়তার চেয়ে আরও বেশি পায়, তা নিশ্চিত করতে কৌশল প্রস্তাব করে জলবায়ু অর্থায়নের সুরাহা করতে চেয়েছিল ব্রিটেন।

সম্মেলনে অংশ নেওয়া ছোটো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর প্রধান দাবি মেনে ২০১৯ সালের পর্যায় থেকে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ২০২৫ সালের মধ্যে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে চুক্তিতে।

যুক্তরাজ্য বলেছে, ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু তহবিল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। আগামী বছর জাতিসংঘ কমিটির অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া উচিত ।

সেই সঙ্গে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে ২০২২, ২০২৪ ও ২০২৬ সালে সরকারগুলো মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানে উপর জোর দিয়েছে যুক্তরাজ্য।

জাতিসংঘ বলছে, বছরে ওই ১০০ কোটি ডলারও গরিব দেশগুলোর প্রকৃত চাহিদা চেয়ে অনেক কম। কারণ, শুধু অভিযোজনের ব্যয় হিসাব করলে ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এছাড়া ফসলের ক্ষতি বা জলবায়ু সম্পর্কিত দুর্যোগ থেকে যে আর্থিক ক্ষতি তারতো হিসাবই করা হয়নি।

আরও পড়ুন