কপ ২৬: গরিব দেশগুলো কী চায়?

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়েই এখন বন্যা, খরা ও দাবানলের মতো বিপর্যয়ের দাপট; আর এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছে গরিব দেশগুলো।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2021, 06:01 PM
Updated : 30 Oct 2021, 06:01 PM

ধনী দেশগুলোর তুলনায় কার্বন নিঃসরণ কম করেও তাদেরই ভুগতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন এসব দেশের কোটি কোটি মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে, ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুমুখে।

যে কারণে গ্লাসগোতে রোববার থেকে শুরু হতে যাওয়া জলবায়ু সম্মেলনে যা যা নিয়ে আলোচনা হবে, তাতে কম সম্পদশালী ও ছোট দেশগুলোর চাহিদা পূরণই সবচেয়ে বেশি গুরু্ত্ব পাওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ বা কপের এবারের ২৬তম আয়োজনে বিশ্ব নেতাদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নতুন ও আগ্রাসী প্রতিশ্রুতিতে একমত হতে চাপ দেওয়া হবে বলে অনেকে ধারণা করছেন।

কিন্তু এ সম্মেলনে দরিদ্র দেশগুলোর চাওয়া কী, তার বিপরীতে ধনী দেশগুলো কী ভাবছে, কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, তারা কীভাবে দরকষাকষি করবে- এক প্রতিবেদনে তাই তুলে আনার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর চাওয়া

কার্বন নিঃসরণ কমাতে ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তার অংশ হিসেবে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ

২০৫০ সালের অনেক আগেই কার্বন নিরপেক্ষ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণে ধনী দেশগুলোর ঐকমত্য; এজন্য প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মতো বড় নিঃসরণকারী দেশগুলোর জন্য লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া

 জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অথবা ঘন ঘন বন্যার মতো দুর্যোগে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া

বিভিন্ন দেশ কীভাবে আগের চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করবে, তার নিয়মকানুন চূড়ান্ত করা

কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে

জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করছে যে ক্ষতিকারণ নিঃসরণ, তার খুব সামান্য অংশের জন্যই দায়ী গরিব দেশগুলো। এখন বিশ্বের ধনী ১ শতাংশ মানুষ যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে তা দরিদ্র ৫০ শতাংশের মিলিত নিঃসরণের দ্বিগুণেরও বেশি।

খাদ্য ও কাজের জন্য পরিবেশের ওপর তুলনামূলক বেশি নির্ভরশীলতা এবং অভিযোজনে ব্যয় করার মতো অর্থ কম থাকায় আবহাওয়ার বিপজ্জনক রূপের প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিও দরিদ্র দেশগুলোর বেশি।

গত ৫০ বছরে ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশে প্রতি ৩ মৃত্যুর মধ্যে দুটি বা তারচেয়েও বেশি হয়েছে খরা, দাবানল ও বন্যার মতো দুর্যোগে, যার পেছনে দায়ী এই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া।

ধনী দেশগুলো কী করছে?

২০০৯ সালে ধনী দেশগুলো গরিব দেশগুলোর চাহিদা পূরণে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উৎস থেকে নিয়ে ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

এই অর্থ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমাতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ভালো বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হত।

কিন্তু ২০১৯ সাল পর্যন্ত ওই জলবায়ু তহবিলে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ৮০ বিলিয়ন ডলারে, এই হারে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য পূরণে ২০২৩ সাল লেগে যাবে বলেই অনেকে মনে করছেন।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বিশ্বকে তা অর্জন করতে হলে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ দেওয়ার একটি চুক্তিতে পৌঁছানো খুবই জরুরি।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গ্লাসগো সম্মেলনের জন্য যে ৪টি বিষয়কে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন, তার মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল বানাতে চুক্তি করার বিষয়টিও আছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

ক্লাইড নদীর তীরে গ্লাসগো সায়েন্স সেন্টারে হবে কপ ২৬ এর মূল সম্মেলন। ছবি: রয়টার্স

সম্মেলনে আসতে ছোট দেশগুলোর বাধা কোথায়?

“বেঁচে থাকার জন্য আমরা দরকষাকষি করছি,” বলেছেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ ও অঞ্চলগুলোকে নিয়ে গঠিত সংগঠন প্যাসিফিক রিজিওনাল এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম কার্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন স্থিতিস্থাপকতা বিভাগের পরিচালক টাগালোয়া কুপার।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপদেশগুলোর কয়েকটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে।

অথচ সম্পদের ঘাটতি থাকায় এ দেশগুলোর পক্ষে জলবায়ু সম্মেলনে বড় প্রতিনিধিদল পাঠানোর ‘বিলাসিতা’ দেখানোর সুযোগ নেই, বলছেন কুপার।

“আমাদের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের অনেকেই সেখানে বলতে পারবে না, এসব আলোচনায় তাদের কথা শোনা যাবে না,” বলেছেন তিনি।

গ্লাসগো সম্মেলনে যাওয়া-আসা ও সেখানে থাকার সময় নিজেকে কোভিড থেকে নিরাপদ রাখাও অনেকের বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশগুলোর প্রতিনিধিদের জন্য বড় বাধা; এই দেশগুলোতে সংক্রমণের হার মহামারীর পুরো সময়জুড়েই ‍তুলনামূলক অনেক কম রয়েছে।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মাত্র ৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা গ্লাসগোর সম্মেলনে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে, অন্যরা ছোট দল বা রাষ্ট্রদূতকে পাঠাচ্ছে।

না আসা অনেক আলোচক ও প্রতিনিধি হয়তো দূরে থেকেই সংযুক্ত হবেন, কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ ও গতি এবং সম্মেলনস্থল ও যেখান থেকে যুক্ত হচ্ছেন, সেখানকার সময়ের পার্থক্যও তাদের অসুবিধার কারণ হতে পারে। 

ছবি: রয়টার্স

গরিব দেশগুলো কীভাবে দরকষাকষি করবে?

বিশ্বমঞ্চে সাধারণত গরিব দেশগুলোর কণ্ঠ ক্ষীণ শোনায়, এজন্য তারা জোট বেধে তাদের সমস্যাগুলো শোনাতে চেষ্টা করে, যেন তার আওয়াজ ঠিক জায়গায় পৌঁছায়।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একটি জোট আছে, যাতে বাংলাদেশ, সেনেগাল, ইয়েমেনসহ ৪৬টি রাষ্ট্র আছে; এলডিসি হিসেবে পরিচিত এই জোট ১০০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বও করছে।

“অগ্রাধিকার ও স্বার্থ এক হলে এই দেশগুলো আলোচনায় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে,” বলেছেন জোটের এখনকার চেয়ারম্যান ভুটানের সোনাম ওয়াংডি।

দেশগুলো এ সম্মেলনকে ঘিরে বছরব্যাপী একসঙ্গে কাজ করেছে, গ্লাসগোতে তারা প্রতিদিন বসবেও।

বিবিসি লিখেছে, দরকষাকষি, আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত গ্লাসগোতে যদি কোনো চুক্তি হতে হয়, তাহলে তাতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করা ১৯৭ দেশের সবাইকে স্বাক্ষর করতে হবে।

এর মানে দাঁড়াচ্ছে, কোনো চুক্তি হতে হলে তা গরিব-ধনী সব দেশের কাছেই গৃহীত হতে হবে।

২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে বিশ্বনেতারা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তার অন্যতম একটি কারণ ছিল সুদান, টুভালুর মতো অনেক গরিব দেশই সেসময় খসড়া চূড়ান্ত হওয়া চুক্তিটির বিরোধিতা করেছিল।