এস আলমের পোড়া চিনির ‘লাভা’ যাচ্ছে কর্ণফুলীতে

একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বেশিমাত্রায় পোড়া চিনি নদীতে মিশে গেলে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে পোড়া বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে পড়া ঠেকানো দরকার।

মিন্টু চৌধুরীও মিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2024, 02:11 PM
Updated : 5 March 2024, 02:11 PM

চট্টগ্রামের এস আলম সুগার রিফাইন্ড মিলে আগুনে পোড়া গুদাম থেকে গলে যাওয়া অপরিশোধিত চিনি গিয়ে পড়ছে পাশের কর্ণফুলী নদীতে।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বেশিমাত্রায় পোড়া চিনি নদীতে মিশে গেলে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে পোড়া বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে পড়া ঠেকানো দরকার।

তবে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, অপরিশোধিত চিনির বর্জ্যে পরিবেশের ‘কোনো ক্ষতি হবে না’।

সোমবার বিকাল ৪টার আগে আগে কর্ণফুলী থানার ইছাপুর এলাকায় এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের চারটি গুদামের মধ্যে একটিতে আগুন লাগে।

ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় রাত সাড়ে ১০ টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত তা পুরোপুরি নেভানো যায়নি।

কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক সংলগ্ন ইছাপুর এলাকায় ১১ মেগাওয়াটের এস আলম পাওয়ার প্লান্টের পাশেই এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিল। পাওয়ার প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ দিয়েই চিনি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম চলে।

কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, রোজার মাস সামনে রেখে মিলের চারটি গুদামে মোট চার লাখ টন অপরিশোধিত চিনি মজুদ করা হয়েছিল। পরিশোধনের পর ওই চিনি বাজারে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে ১ নম্বর গুদামের এক লাখ টন চিনি পুড়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অপরিশোধিত চিনি মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের একটি যৌগ। কার্বন ও অক্সিজেন দুটোই আগুন জ্বলতে সহায়তা করে। ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অপরিশোধিত চিনি গলে গিয়ে ভোলাটাইল কেমিকেলে (ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক) পরিণত হয়।এখন এই আগুন নেভাতে আমরা পানি দিয়ে চেষ্টা করছি।”

দুপুরে কারখানায় ঢুকে দেখা যায়, মূল ফটক থেকে প্রায় চারশ ফুট দূরে এক নম্বর গুদাম জ্বলছে। এক নম্বর গুদামটি ৬৫ হাজার ৭০০ বর্গফুটের। মূল ফটক থেকে গুদাম পর্যন্ত পুরো রাস্তায় অপরিশোধিত চিনি গলে লালচে কালো কাদার মত তরল ছড়িয়ে আছে।

লাভার মত ওই তরল ১ নম্বর গুদামের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে গুদামের পশ্চিম পাশে একটি নালায় পড়ছে। নালাটি চলে গেছে নদীর দিকে। গলিত চিনির বর্জ্য ওই নালা দিয়ে সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়েছে। লালচে-কালো তরল মিশে পানির রঙও বদলে যাচ্ছে।

সেখানে কথা হয় এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এক শ্রমিকের সাথে। তিনি ১২ বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শ্রমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আগুন লাগার পর যে কালো পানিটা বের হচ্ছে, সেটা এখানে নদীতে ছাড়া হচ্ছে। অন্য সময়ও চিনি তৈরির পর যে ময়লা অবশিষ্ট থাকে, সেগুলো এ নালা দিয়ে নদীতে ফেলা হয়। নালাটা করা হইছে ময়লা নদীতে ফেলার জন্য।"

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এস আলম গ্রুপের জিএম (কর্মাশিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, "এটা র সুগার। এখানে ক্ষতি হয় তেমন কোনো কেমিকেল নেই। পরিবেশের কোথাও ক্ষতি হবে না। পোড়া র সুগার আমরা ব্র্র্র্যাকেট করে ফেলছি। ড্রেন থেকে ডাম্পিং স্টেশনে যাচ্ছে। নদীতে যাচ্ছে না।"

একই ধরনের কথা বললেন ঢাকা থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক (প্রশাসন) মো. জসিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, “র মেটেরিয়াল এখানে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টন। তারা এমন সিস্টেম রেখেছে যাতে নদীতে না যায়। আর গেলেও তেমন ক্ষতি হবে না। এটা র সুগার, উপকরণে তেমন ক্ষতিকর কিছু নেই।"

তবে ওই পোড়া চিনিতেও বিপদ দেখছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনির উদ্দিন।

তিনি বলেন, “পোড়া অপরিশোধিত চিনির বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ার ফলে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে। পানির মাত্রা মান কমে গিয়ে ইকোলজিক্যাল অসামঞ্জস্যতা তৈরি হতে পারে।

“বিশেষ করে বিওডি (বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড), সিওডি (কেমিকেল অক্সিজেন ডিমান্ড) এবং ডিও (দ্রবীভূত অক্সিজেন) মাত্রায় হেরফের হতে পারে। পানির মান কমার সাথে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে এবং নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।”

অধ্যাপক মনির বলেন, “এমনিতেই আমাদের দেশে নদীর পাড়ে যত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তারা কোনো ধরনের প্রোটেকশন ছাড়াই সরাসরি বর্জ্য ফেলে। কর্ণফুলীতেও এর ব্যতিক্রম নেই। তবে জোয়ারভাটার নদী হওয়ায় কিছুটা রক্ষা। এজন্য আমাদের তদারককারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী।”

তার পরামর্শ, নদীর পানি দূষণ বন্ধের জন্য এস আলম সুগার মিল থেকে গলা বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা আটকাতে হবে এবং এবং সেগুলো সঠিক প্রিক্রিয়ায় ডাম্পিং করতে হবে।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাগারের একটি দলও মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। গবেষণাগারের চিফ কেমিস্ট কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখবেন পানির মান কতটা বদলাচ্ছে।

আগুনের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটিও মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে।

তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমরা আপনাদের কাছ থেকে বিষয়টি জানলাম। আমরা দেখব পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না। নদীতে কোনো আবর্জনা পড়ছে কিনা।"