কপ ২৬ কী, কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যে এ বছর গুরুত্বপূর্ণ যে সম্মেলন হতে যাচ্ছে, তা সফল হলে বিশ্ববাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রাতেও দেখা যেতে পারে বড় পরিবর্তন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Oct 2021, 06:54 PM
Updated : 17 Oct 2021, 07:25 AM

চলতি মাসের শেষদিন, অর্থ্যাৎ ৩১ অক্টোবর থেকে গ্লাসগোতে এ কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) ২৬তম আয়োজন শুরু হচ্ছে, যা ১২ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা।

এবারের কপে যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হতে পারে, সম্মেলনটি সফল বা ব্যর্থ হলে মানুষের উপর তার কী কী প্রভাব পড়তে পারে, এক প্রতিবেদনে তারই বিভিন্ন দিক তুলে এনেছে বিবিসি।

কপ ২৬ হচ্ছে কেন?

মানুষের কারণে যে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গত হচ্ছে, তা বিশ্বকে ক্রমাগত আরও উষ্ণ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে দাবদাহ, বন্যা ও দাবানলের মতো ঘটনা বাড়ছে,এবং এগুলোর মাত্রা দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে।

গত দশক ছিল রেকর্ড অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণ। এই পরিস্থিতি বদলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষযে একমত হয়েছে।

এবারের সম্মেলনে ২০০ দেশের কাছে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা কী তা জানতে চাওয়া হবে।

২০১৫ সালে এই দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, যেন এর চেয়ে ‘অনেক কম’ সম্ভব হলে প্রাক শিল্পায়ন যুগের তাপমাত্রার চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যে রাখা যায়, তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়েছিল।

এটাই প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত; এই চুক্তির ফলে কার্বন নিঃসরণ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্যত শূন্যে নামিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশকে এখন কার্বন নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমাতে হবে।

ছবি: রয়টার্স

কী কী সিদ্ধান্ত আসতে পারে?

সম্মেলন শুরুর আগেই বেশিরভাগ দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানো বিষয়ক তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলবে; ফলে আগেভাগেই বোঝা যাবে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বিশ্ব থাকছে কি না।  

দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনে নতুন নতুন অনেক ঘোষণাও আসতে পারে। এসব ঘোষণার বেশিরভাগই হতে পারে ‘খুবই টেকনিক্যাল’; যেমন হতে পারে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে আরও যেসব নিয়মকানুন থাকা দরকার, সেগুলো যোগ করা।

আরও যে যে ঘোষণা আসতে পারে, তার মধ্যে আছে-

>>   জ্বালানিনির্ভর গাড়ি থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক গাড়িতে চলে যাওয়া

>>   কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের পথ থেকে সরে আসার গতি বাড়ানো

>>   গাছ কাটা কমানো

>>   উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অর্থায়নসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আরও বেশি মানুষকে রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া

গ্লাসগোতে এবারের সম্মেলনে বিশ্বনেতা, মধ্যস্থতাকারী ও সাংবাদিকসহ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ২৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারণা আয়োজকদের।

হাজার হাজার পরিবেশকর্মী ও ব্যবসায়ীরাও শহরটিতে নানান অনুষ্ঠান করবে, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াবে ও বিক্ষোভ করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

সম্মেলন শেষে একটি ঘোষণা আসার কথা, যেখানে সবগুলো দেশের স্বাক্ষর থাকবে এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকবে।

কপ ২৬ এর প্রেসিডেন্ট অলোক শর্মা। ছবি: রয়টার্স

বাদানুবাদ হতে পারে যা যা নিয়ে

অর্থ এবং জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচার নিয়ে অনেক কথা হবে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে কম; অতীতে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণের দায়ভারও তাদের নয়। অথচ তাদেরকেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে।

নিজেদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। কয়লার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে আরও সোলার প্যানেল দরকার, দরকার বন্যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত তা নিয়েও বিতর্কে জড়াতে পারে বিভিন্ন পক্ষ।

ধনী দেশগুলো এর আগে দরিদ্র দেশগুলোকে এ খাতে ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি ‍পূরণ হচ্ছে না বলে গত বছর এক মূল্যায়নে জানিয়েছিল জাতিসংঘ। যে কারণে এবার ধনী দেশগুলোর কাছে আরও অর্থ চাওয়া হতে পারে।

কপ ২৬-এ চীনের প্রতিশ্রুতিও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। বিশ্বজুড়ে কয়লাবিদ্যুতে বিনিয়োগ করা দেশটি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশও।  

চীন ও অন্যান্য বড় জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদকরা কত দ্রুত এ ধরনের জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে আগ্রহ দেখায় পর্যবেক্ষকদের নজর থাকবে সেখানেও।

কপ ২৬ দৈনন্দিন জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে?

গ্লাসগো সম্মেলনে এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আসতে পারে যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

পেট্রলচালিত গাড়ি ব্যবহার করা যাবে কি না, গ্যাস বয়লার দিয়ে ঘর গরম করতে কিংবা ঘন ঘন বিমানে চড়া যাবে কি না, কপ-২৬ এর সিদ্ধান্ত এ সবকিছুর উপরই প্রভাব ফেলতে পারে।

ধরিত্রী রক্ষার দাবিতে জলবায়ুকর্মীরা সরব সারাবিশ্বেই। ছবি: রয়টার্স

যেসব শব্দ বেশি বেশি শোনা যাবে

কপ ২৬: কপ হচ্ছে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের সংক্ষিপ্ত রূপ। জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত কপের প্রথম সম্মেলন হয় ১৯৯৫ সালে। এবার হচ্ছে এর ২৬তম আয়োজন।

প্যারিস চুক্তি:  বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবেলা ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে প্রথমবারের মতো বিশ্বের দেশগুলো ২০১৫ সালে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়, এটিই প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত।  

আইপিসিসি: জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এই আন্তঃদেশীয় প্যানেল জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে করা সর্বসাম্প্রতিক সব গবেষণা যাচাই করে দেখে।

১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস: বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচা যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে গত ২৩ জুলাই লন্ডনে বিক্ষোভে প্ল্যাকার্ড হাতে একজন। ছবি: রয়টার্স

কপ ২৬ সফল কি না, কীভাবে বোঝা যাবে

আয়োজক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের চাওয়া থাকবে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কার্যত শূন্যে নিয়ে আসার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সব দেশ যেন তার সমর্থনে ও ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমানোর প্রতিশ্রুতি সম্বলিত দৃঢ় বার্তা দেয়।

কয়লা ও পেট্রলচালিত গাড়ি বন্ধ এবং পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেবে, এমনটাও প্রত্যাশা করবে তারা।

উন্নয়নশীল দেশগুলো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়ক হয় এমন মোটা অংকের অর্থ চাইবে।

এর যে কোনো একটাও যদি অর্জিত না হয়, তাহলেই কপ ২৬ এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে; কেননা, তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি রাখার লক্ষ্যমাত্রাকে জীবিত রাখতে হাতে যে খুব বেশি সময় নেই।

অবশ্য কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, বিশ্বনেতারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন। এখন তারা কপ ২৬-এ যা নিয়েই একমত হন না কেন, কোনো লাভ নেই, দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।