জলবায়ু পরিবর্তন: আইপিসিসির প্রতিবেদনে মানবজাতির জন্য সতর্কবার্তা

মানুষের কর্মকাণ্ড এই পৃথিবীর জলবায়ুকে অল্প সময়ে যেভাবে বদলে দিয়েছে, তেমনটা লাখো বছরেও ঘটেনি। আর এই পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে আর সংশোধনের উপায় নেই, যা মানবজাতিকে অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2021, 09:29 AM
Updated : 9 August 2021, 03:03 PM

জাতিসংঘ গঠিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদন বলছে, পৃথিবীর উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে চূড়ান্ত বিপদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে মানবসভ্যতা। আর সেজন্য মানুষই পুরোপুরি দায়ী।

‘নীতিনির্ধারকদের জন্য সারসংক্ষেপ’ শিরোনামে সোমবার প্রকাশিত ৪২ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী দুই দশকের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে।

এর মানে হল, ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে উষ্ণায়নকে যে মাত্রায় বেঁধে রাখার অঙ্গীকার বিশ্বনেতারা করেছিলেন, তা পূরণ করা হয়তো সম্ভব হচ্ছে না।

আর এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফল হবে মারাত্মক। এ শতকের শেষে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা আর উড়িয়ে দিতে পারছেন না।

বিবিসি লিখেছে, ছোট হলেও একটি আশার আলো রয়েছে আইপিসিসির গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদনে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ ব্যাপক হারে কমিয়ে আনা গেলে বাড়তে থাকা উষ্ণতায় ভারসাম্য ফিরে আসতে পারে। 

কয়েকশ বিশেষজ্ঞের গবেষণা ও সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রায় ৮ বছর ধরে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইপিসিসি, যেখানে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সবশেষ বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮৮ সাল থেকে আইপিসিসি এমন ছয়টি প্রতিবেদন দিয়েছে।

এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত জলবায়ু বদলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলে বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়া, তাপদাহ, বন্যা আর খরার মত ঘটনা বাড়ছে মানুষের নানা কার্যক্রমের কারণেই।

এ প্রতিবেদনকে মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা বা ‘কোড রেড’ হিসেবে বর্ণনা করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জ্বালানি হিসেবে কয়লা এবং উচ্চমাত্রায় দূষণ ঘটানো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমাদের গ্রহটাকে ধ্বংস করে ফেলার আগে এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই কয়লা ও ফসিল ফুয়েলের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো উচিত।”  

১ থেকে ১২ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’ বসার তিন মাস আগে আইপিসিসির এ প্রতিবেদন প্রকাশ হলো। জলবায়ু প্রশ্নে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এবং তহবিল যোগানোর বিষয়ে ধনী দেশগুলোকে সেখানে চাপের মধ্যে থাকতে হবে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “যদি আমরা সব শক্তি এক করতে পারি, তাহলে হয়ত জলবায়ু বিপর্যয় এড়িয়ে যেতে পারব। তবে আজকের এই প্রতিবেদন এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দেরি করার সময় বা অজুহাত দেখানোর কোনো সুযোগ আর আমাদের নেই। আমি সব সরকারপ্রধান এবং এর অংশীদারদের কপ-২৬ সফল করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
 
আইপিসিসি’র এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে এমন একটি সমীক্ষার রচয়িতা যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি অব রিডিং’ অধ্যাপক এড হকিন্স বলেন, বিজ্ঞানীদের পক্ষে ‘এর চেয়ে স্পষ্ট ’ করে আর কিছু বলার নেই।

“এটা হচ্ছে বাস্তব অবস্থার বর্ণনা, এর চেয়ে নিশ্চিত করে আমাদের পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব নয়; এটা সর্বজনসম্মত এবং বিতর্কেরও ঊর্ধ্বে যে মানুষই পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলছে।”

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব পেত্তেরি তালাস বলেন, “ক্রীড়া জগতের শব্দ ব্যবহার করে যে কেউ বলতে পারেন, বায়ুমণ্ডল ডোপিং এর মুখোমুখি হয়েছে, মানে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি চরম অবস্থা দেখছি।”

এই গবেষক জানান, ১৯৭০ সালের পর থেকে পৃথিবীর উপরিভাগের তাপমাত্রা গত দুই হাজার বছরের মধ্যে
যে কোনো ৫০ বছর সময়কালের হিসাবে সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে।

“তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এই ঘটনা এরই মধ্যে সারা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিস্থিতিকে চরমভাবাপন্ন করে তুলেছে।”

ফাইল ছবি

আইপিসিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, শিল্পায়ন শুরুর পর থেকে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে কার্বন নিঃসরণের ফলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বায়ুমণ্ডলে দূষণের প্রভাবে সেটা আরও শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে।
যার অর্থ হল, মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে না দাঁড়ালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রবণতা কমানো যাবে না।    
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, তাপমাত্রা যদি প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যায়, তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং তার প্রভাব হবে ধ্বংসাত্মক। তখন পৃথিবী এতটাই উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে, যে কোনা শস্যই হয়ত ফলানো যাবে না। কিংবা বাইরে বের হলেই মানুষের মৃত্যু হবে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, প্রতি শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কিছু অঞ্চলে তাপদাহ, ভারি বৃষ্টিপাত কিংবা চরম খরা দেখা দেবে। এক বছরের সঙ্গে অন্য বছরের তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হওয়ায় বিজ্ঞানীরা প্রতি ২০ বছরের গড় তাপমাত্রাকে এক্ষেত্রে হিসাবে ধরছেন।

আইপিসিসির প্রতিবেদন তৈরিতে তৃতীয়বারের মত কাজ করা সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সোনিয়া সেনেভিরত্নে বলেন, “আমরা যে জলবায়ু সঙ্কটে আছি তা প্রমাণে আমাদের কাছে সব আলামতই আছে।

“নীতিনির্ধারকদের কাছে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। আপনারা জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, যদি কিছুই না করা হয়, তাহলে কী বিজ্ঞানীদের এই সময়ের অর্থপূর্ণ ব্যবহার হল?”    

বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলেই আবহাওয়ার বিপর্যয় ঘটছে। এ বছর তাপদাহের ফলে উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলেও দাবানল দেখা গেছে।

তীব্র গরম আর খরার সঙ্গে দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শহর। পশ্চিমে সাইবেরিয়ার জঙ্গলে দাবানলের কারণে রেকর্ড পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, দাবানলের কারণে গ্রিসের একটি দ্বীপের অধিবাসীরা সরে যেতে বাধ্য যাচ্ছে।  

আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর এ পরিবর্তন ধীরে হলেও বিশ্ববাসীর ‘সময় ফুরিয়ে আসছে’। আগামী দশকে কার্বন নিঃসরণ ব্যাপক মাত্রায় কমানো গেলেও ২০৪০ সাল নাগাদ গড় তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। ২০৬০ সাল নাগাদ তা হতে পারে ১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

আর যদি ব্যাপক হারে নিঃসরণ কমানো না যায় এবং বর্তমান গতি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৬০ সালেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হতে পারে এবং চলতি শতকের শেষে তা হতে পারে ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

১৯৭টি দেশের উপস্থিতিতে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আইপিসিসির এ প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ রক্ষায় আগামী দশকটি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  

তিনি বলেন, “আমি আশা করি, নভেম্বরে গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনের আগে বিশ্বকে এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এই প্রতিবেদনটি হয়ে উঠবে জেগে ওঠার ডাক।”

আইপিসিসির প্রতিবেদনে এ মুহূর্তের জরুরি অবস্থাই তুলে ধরা হয়েছে মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি বলেন, “সুযোগ শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বকে এক হতে হবে… গ্লাসগোতেই এই সংকটের মোড় বদলাতে হবে আমাদের।”