জলবায়ু পরিবর্তন: যেখানে কদাচিৎ দাবানল হত, সেখানেও ছড়াচ্ছে আগুন

বিশ্বের সবচেয়ে শীতল শহর হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় ইয়াকুটস্ক। এ এমন এক এলাকা, যেখানে শীতকালে নাক ঢাকা না থাকলে ঠাণ্ডায় প্রচণ্ড ব্যথায় ভুগতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বরফ শীতল আবহাওয়ায় মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত, সকালে উঠে কয়েক পরতের পোশাক পরতেই তাদের অনেকটা সময় চলে যায়।

নিউজ ডেস্ক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2021, 06:54 PM
Updated : 24 July 2021, 06:54 PM

অথচ সেই শহরটিই এখন ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা পড়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহ চলার ফলে কাছের বনাঞ্চল দাবানলে পুড়ছে। আগুন এতোটাই বড়, আর বাতাসের বেগ এত বেশি যে, এর ধোঁয়া সুদূর আলাস্কা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন রাজ্যের বুটলেগ দাবানল বিকট আকার নিয়েছে, তার ঘন ধোঁয়া মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তিন হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

নিউ ইয়র্ক শহর গত বুধবার ঘুম ভেঙে দেখেছে গাঢ় লাল সূর্য। চারপাশে দাবানলের গন্ধ, ঘন বাদামী ধোঁয়াশা।

সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মত কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা জল-বোমা আর হোস পাইপ নিয়ে লেলিহান আগুন নেভানোর এক প্রায় অসম্ভব লড়াইয়ে অবতীর্ণ। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য তারা মাটি কেটে, গাছ উপড়ে ফেলে আগুনের স্রোতে ছেদ টানার চেষ্টা করছেন।

 

সাইবেরিয়ার ইউকুটিয়া প্রদেশে মঙ্গলবার ধোঁয়া এত ঘন ছিলো যে তল্লাশী ফ্লাইটের পাইলট সভিয়াতোস্লাভ কোলেসভ আকাশে উড়ে কিছুই দেখতে পাননি।

রাশিয়ার সুদূর পুবের ইয়াকুটিয়া প্রদেশের এয়ার অবজারভেশন পোস্টের একজন জ্যেষ্ঠ বৈমানিক কোলেসভ। সাইবেরিয়ার ওই অংশটি এমনিতেই দাবানলপ্রবণ, সেখানে একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বনভূমি। কিন্তু এ বছর দাবানলের চেহারা পুরোপুরি অন্যরকম বলে কোলেসভের মনে হচ্ছে।

সিএনএনকে তিনি বলেন, “ইয়াকুটিয়ার উত্তরে নতুন করে আগুন ধরেছে। ওখানে গত বছরও আগুন ধরেনি, আগেও কখনো ওই এলাকায় দাবানাল হয়নি।”

কোলেসভ এখন যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, সেই পূর্বাভাস কয়েক বছর ধরেই দিয়ে আসছিলেন বিজ্ঞানীরা। দাবানল এখন আগের চেয়ে আরও বড় আর তীব্র হচ্ছে। এমন সব এলাকায় দাবানল দেখা দিচ্ছে যেখানে আগে দেখা যেত না।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের পরিবেশগত ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক টমাস স্মিথ সিএনএনকে বলেন, “আগুনের মৌসুম এখন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, দাবানল হচ্ছে বড় এলাকা নিয়ে, তীব্রতার মাত্রা থাকছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।”

তার মতে, দুর্বল ভূমি ব্যবস্থাপনার মতো অনেক কারণ এসব দাবানল সৃষ্টির জন্য ভূমিকা রাখছে। তবে ঘন ঘন দাবানল সৃষ্টি এবং এর রাক্ষুসে চেহারা পাওয়ার পেছনে মূল অবদান রাখছে জলবায়ুর পরিবর্তন।

 

কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণপশ্চিম কানাডা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অঞ্চল এখন আগের তুলনায় বেশি শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। তাতে এসব এলাকার বনাঞ্চলগুলো হয়ে উঠছে শুকনো খড়ের গাদার মতই দাহ্য।

রাশিয়ার এরিয়াল ফরেস্ট প্রটেকশন সার্ভিসের তথ্য বলছে, এ বছরের শুরু থেকে ইয়াকুটিয়ায় ৬৫ লাখ একর বনভূমি পুড়িয়েছে দাবানল, যা প্রায় ৫০ লাখ ফুটবল মাঠের সমান এলাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনে অগ্নিকাণ্ডের আটটি ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ ৭৫ হাজার একর এলাকা পুড়েছে বলে জানিয়েছেন একজন স্থানীয় কর্মকর্তা। তিনি বলছেন, এমন ব্যাপক আকারে আগুন লাগতে তারা আগে দেখেননি।

বুটলেগের দাবানলের ব্যাপ্তি এত বেশি এবং সেখানে এত বেশি তাপ ও শক্তি উৎপাদন হচ্ছে যে সেখানে মেঘ ও বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে।

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে দাবানলের কারণে বুধবার থেকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৩০০ আগুন ধরার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

সিএনএন লিখেছে, এসব দাবানল চরম জলবায়ু চক্রের অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু আগুন ধরাচ্ছে না, এসব দাবানলের কারণে বায়ুমণ্ডলে আরও বেশি কার্বন গ্যাস ছড়াচ্ছে, যা সংকট বাড়িয়ে তুলছে। আর কয়েকজন বিজ্ঞানী বলেছেন, এ বছরের দাবানলগুলো এসেছে আরও বেশি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে।

 

কোপারনিকাস অ্যাটমসফেয়ার মনিটরিং সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মার্ক প্যারিংটন সিএনএনকে বলেন, “এ বছরের জুলাইয়ের মধ্যভাগ পর্যন্ত মোট কার্বন নিঃসরণ আগের বছরগুলোর পুরো গ্রীষ্মজুড়ে নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ সমস্যা দিনে দিনে বড় হচ্ছে।”

তিনি বলেন, জুনের শেষের কয়েক দিন থেকে এখন পর্যন্ত ইয়াকুটিয়ায় উচ্চ মাত্রার আগুন ধারাবাহিকভাবে জ্বলছে।

“সময়ের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগুন ধরার পর্যায়গুলোর মধ্যে তীব্রতা বাড়া কমার এক ধরনের সাযুজ্য থাকে। কিন্তু এবারের মত তিন সপ্তাহ ধরে পুড়িয়ে চলেনি আগের কোনো দাবানল। আগে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আগুন জ্বলেছে হয়ত দুই সপ্তাহ বা ১০ দিন পর্যন্ত।”

মার্ক প্যারিংটন জানান, সাধারণত অগাস্টের মধ্যভাগ পর্যন্ত দাবানলের মৌসুম অব্যাহত থাকে, সুতরাং এই দাবানল আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।

আরও ঘন ঘন এবং আরও তীব্র

স্মিথ সিএনএনকে বলেন, সাইবেরিয়া ও কানাডার কিছু অংশে সবসময়ই দাবানল দেখা দেয়, কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হল দাবানল এখন আগের চেয়ে ঘন ঘন হচ্ছে।

“একটা সময় হয়ত আপনি প্রতি একশ বা দেড়শ বছরে একটা বড় দাবানল দেখতেন। তার মানে হল, পুড়ে যাওয়ার পর বনাঞ্চল আবার পুরোপুরি বেড়ে ওঠার সুযোগ পেত। তারপর আবার হয়ত আগুন লাগত, তারপর আবার নতুন কেরে গড়ে উঠত পরিপূর্ণ বনাঞ্চল।

“কিন্তু এখন সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশে প্রতি ১০ থেকে ৩০ বছরে একবার দাবানল দেখা দিচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে বনাঞ্চলগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারছে না। ফলে বনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র বদলে যাচ্ছে। অরণ্য হয়ত গুল্মের জঙ্গল বা সোয়াম্পল্যান্ডের চেহারা পাচ্ছে।”

তাপপ্রবাহ ও খরা পরিস্থিতিও নতুন নতুন এলাকাকে আগুনের ঝুঁকিতে ফেলছে।

স্মিথ বলেন, “সাইবেরিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের উত্তরে তুন্দ্রা বনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, কারণ ওই অঞ্চল সাধারণত ভেজা ও বরফে আচ্ছাদিত থাকে যা আগুন ধরার অনুপোযোগী। অথচ গত দুই বছরে সেখানে অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। তার মানে হল, সেখানকার পরিস্থিতি আর আগের মত নেই।”