হামলায় আহত সালমান রুশদি ভেন্টিলেটরে, কথা বলতে পারছেন না

এই লেখকের ঘাড় ও পেটে অন্তত একবার করে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তিনি চোখ হারানোর ঝুঁকিতেও রয়েছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2022, 03:47 PM
Updated : 12 August 2022, 03:47 PM

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের এক অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছুরি হামলার শিকার হওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঔপন্যাসিক সালমান রুশদির ‘খবর ভালো নয়’ বলে জানিয়েছেন তার বইয়ের এজেন্ট।

শুক্রবার স্থানীয় সময় সকালে অঙ্গরাজ্যটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শাটাকোয়া ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন বুকারজয়ী এই লেখক। যখন তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখনই এক লোক দৌড়ে স্টেজে উঠে ছুরি নিয়ে তার ওপর হামলা চালায়।

৭৫ বছর বয়সী রুশদির ঘাড়ে ও শরীরে জখম হয়েছে বলে নিউ ইয়র্ক পুলিশ জানিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তার ঘাড়ে ও পেটে অন্তত একবার করে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আহত রুশদি পেনসেলভেইনিয়ার ইরি হাসপাতালে আছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, কয়েক ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর শুক্রবার সন্ধ্যায় রুশদিকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়।

তার বইয়ের এজেন্ট অ্যান্ড্রু ওয়াইলি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, রুশদিকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে এবং তিনি কথা বলতে পারছেন না; এই লেখক এক চোখ হারাতে পারেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এক ইমেইলে ওয়াইলি লিখেছেন, “খবর ভালো না। সালমান এক চোখ হারাতে পারেন। তার বাহুর স্নায়ু বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তার যকৃতেও ছুরির আঘাত লেগেছে আর তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসের জন্য তিন দশকের বেশি সময় ধরে হত্যার হুমকি পেয়ে আসছিলেন এর লেখক রুশদি।

বিবিসি জানিয়েছে, এ ঘটনায় পুলিশ হাদি মাতার (২৪) নামের এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সে নিউ জার্সির ফেয়ারভিউয়ের বাসিন্দা। সে একটি পাস কিনে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেছিল।

পুলিশ শাটাকোয়া ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানস্থল থেকে একটি ব্যাকপ্যাক ও কিছু ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস উদ্ধার করেছে। এখন সেগুলো পরীক্ষার জন্য একটি সার্চ ওয়ারেন্ট পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে তারা। হামলার উদ্দেশ্য বা হাদির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠনের কথা নিশ্চিত করেনি পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, তারা হামলার উদ্দেশ্য নির্ধারণে ফেডারেল তদন্তকারীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। হামলায় কী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তারা তার বর্ণনা দেননি।

মঞ্চে রুশদির পাশে থাকা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হেনরি রিজও মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তবে তার আঘাত গুরুতর নয়।

হুমকির মুখে নির্বাসিত লেখকদের আশ্রয় ও সহায়তা দেয়- এমন একটি অলাভজনক সংস্থার সহ প্রতিষ্ঠাতা হেনরি রিজ।

সোশাল মিডিয়ায় আসা এক ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ঘটনার পরপরই দর্শকশ্রোতারা দৌড়ে মঞ্চে উঠে যান। হামলাকারীকে তারা ধরে ফেলেন আর সে মেঝেতে পড়ে যায়।

নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্য পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করে।

স্থানীয় বাফেলো নিউজের একজন সাংবাদিক বলেছেন, কালো মাস্ক পরিহিত ওই হামলাকারী দর্শক সারি থেকেই উঠে এসেছিল।

আহমেদ সালমান রুশদির জন্ম ১৯৪৭ সালে মুম্বাইয়ে এক কাশ্মীরি মুসলিম পরিবারে, ভারত ভাগের ঠিক আগে আগে। ১৯৮১ সালে তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ প্রকাশিত হলে লেখক হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের ছকে ফেলে জাদু বাস্তবতার মিশেলে লেখা তার সেই উপন্যাস ম্যান বুকার পুরস্কার জিতে নেয়। শুধু যুক্তরাজ্যেই বইটি বিক্রি হয় দশ লাখ কপির বেশি।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত রুশদির চতুর্থ উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বিশ্বজুড়ে বিতর্কের জন্ম দেয়। বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

বিক্ষোভ আর সহিংসতার মধ্যে বহু দেশে বইটি নিষিদ্ধ করে, রুশদির জন্মস্থান ভারতের সরকারই প্রথম সেই সিদ্ধান্ত নেয়।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি সে সময় এই লেখকের মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া ঘোষণা করেন। রুশদির মাথার দাম ঘোষণা করা হয় ৩০ লাখ ডলার। ইরানের সেই ঘোষণা এখনও বহাল আছে। পরবর্তীতে ইরান সরকার খোমেনির ওই ঘোষণার বিষয়ে আর আগে না বাড়লেও সরকার সমর্থিত একটি ধর্মীয় ফাউন্ডেশন ২০২১ সালে পুরস্কারের ওই অংকের সঙ্গে আরও ৫ লাখ ডলার যোগ করার ঘোষণা দেয়।

ভারতের একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও রুশদি নিজেকে একজন নিরীশ্বরবাদী হিসেবেই পরিচয় দেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার একজন কট্টর সমর্থক তিনি।

ইরান তার মাথার দাম ঘোষণা করার পর প্রায় দশ বছর একপ্রকার পালিয়ে থাকতে হয় রুশদিকে। এর মধ্যেই ১৯৮৯ সালে লেবাননের একটি ইসলামিক দল বইয়ের ভেতরে বোমা ভরে লন্ডনের এক হোটেলে পাঠায় রুশদিকে হত্যার জন্য। তবে বোমাটি আগেভাগে বিস্ফোরিত হওয়ায় হোটেলের দুটি তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হামলাকারী নিজেও নিহত হয়।

দীর্ঘদিন ব্রিটিশ সরকারের নিরাপত্তায় থাকার পর ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বসবাস করতে শুরু করেন রুশদি। পরে তিনি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন।

২০০৭ সালে ব্রিটিশ রানী তাকে নাইট খেতাব দিলে পাকিস্তান ও ইরান তীব্র প্রতিবাদ জানায়। রুশদির অংশগ্রহণের কারণে বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনেও হামলার হুমকি দেওয়া হয়।

হুমকি মাথায় নিয়ে রুশদি নিজে বহু বছর অক্ষত থাকতে পারলেও স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের সঙ্গে জড়িত সবার ভাগ্যে তা ঘটেনি। বইটির নরওয়েজিয়ান প্রকাশক ৯০ এর দশকের শুরুতে আততায়ীর গুলিতে গুরুতর আহত হন। আর জাপানি ভাষায় বইটির অনুবাদককে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।

এই অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেও রুশদি লেখা চালিয়ে গেছেন। এ পর্যন্ত তার ১২টি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সংকলন এবং শিশুদের জন লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

অনেকের বিচারে সমকালীন সাহিত্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান লেখক রুশদির পরবর্তী উপন্যাস ‘ভিক্টোরি সিটি’ আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বাজারে আসার কথা রয়েছে।