ইউক্রেইনের চাষিদের লড়াই এখন মাইনের সঙ্গে

রুশ বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্নের মধ্যে নতুন মৌসুমে ফসল বুনতে এখন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে ইউক্রেইনের কৃষকদের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2023, 03:32 AM
Updated : 28 March 2023, 03:32 AM

রাশিয়ার আক্রমণের পর প্রথম যখন নিজের খামারে এসেছিলেন ওলেক্সান্দর হাব্রিউক, তখন তার চোখে নামে জলের ধারা, রুশ সেনাদের রেখে যাওয়া ধ্বংসচিহ্ন দেখে।

খামারের ভবনগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, লাখ লাখ ডলারের ভারী যন্ত্রপাতির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, আর গত বছরের ফসল (গম) দেওয়া হয়েছে পুড়িয়ে। কিন্তু এর চেয়ে বড় পরীক্ষা হাব্রিউকের সামনে- ক্ষেতের প্রায় ১২ বর্গ মাইলজুড়ে পোঁতা স্থল মাইন।

আগামী এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া চাষের মৌসুম ধরতে ৬৯ বছর বয়সী এই ইউক্রেনিয়ান এখন হাত দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে মাইন সরাচ্ছেন।

সিএনএনের সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপে হাব্রিউক বলছিলেন, “আমি ভয় পাচ্ছিলাম, কিন্তু আমাকে বীজ তো বপন করতে হবে।”

নিজেই একটা মেটাল ডিটেক্টর কিনে নিয়েছেন তিনি; এ যন্ত্রের উপর ভর করে ইতোমধ্যে ২০টির মধ্যে মাইন সরিয়েছেন।

ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর ইজুমের ভালিকা কমশুওকা এলাকার এই খামারে যন্ত্রটি হাতে নিয়ে নিজের প্রচেষ্টার কথা সিএনএনকে বলছিলেন হাব্রিউক।

“আপনি যান, খুঁজতে থাকুন, হাতে একটা লাঠি নিন; এটি দিয়ে (মাইনে) আকার নির্ধারণের চেষ্টা করুন এবং এরপর খনন করুন। তারপর আলতো করে তুলে সরিয়ে ফেলুন।”

কাজটি যে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ তা মেনেই হাব্রিউক বলছেন, “আমার যে আর কোনো উপায় নেই।”

এই কঠিন কাজই ইউক্রেইনজুড়ে চাষিদের করতে হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে গত বছর তাদের কোনো আয়ের সুযোগ ছিল না, আর এবার বিস্ফোরক সরাতেই কাহিল দশা।

রুশ আগ্রাসনের কারণে ইতোমধ্যে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’ ইউক্রেইন থেকে শস্য রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ রুটির মতো খাদ্যশস্যের অন্যতম জোগানদাতা দেশটির রপ্তানির কারণে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম নাগালে থাকে।

ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনী ধারণা করছে, দেশটির এক-তৃতীয়াংশ এলাকাজুড়ে অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ আছে। তাতে করে এ বছর ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি আছেন, যিনি দক্ষিণাঞ্চলীয় চেরভোন গ্রামে কাজ করার সময় বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান বলে স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ফসলের মাঠ থেকে মাইন সরানোর সরকারি কাজ ইতোমধ্যে শুরু হলেও তা চলছে ধীরগতিতে, তাছাড়া এই কাজ বেশ ব্যয়বহুল।

সামরিক বাহিনীর মিডিয়া সেন্টারের তরফে বলা হয়েছে, এক বছর ধরে ৪৫ হাজার বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করেছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।

মাইন সরানোর বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান দ্য হালো ট্রাস্টের ৭০০ কর্মী বর্তমানে ইউক্রেইনে কাজ করছে। বেসরকারি এ সংস্থাটি এ বছর নাগাদ সেখানে কর্মীর সংখ্যা দ্বিগুণ করতে চায়।

ইউক্রেইনে হালো ট্রাস্টের কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া মেইরি কানিংহ্যাম সিএনএনকে বলেন, “বিস্ফোরকের পরিমাণ বিপুল এবং পুরো দেশজুড়েই সেসব ছড়িয়ে আছে। এত বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক সরানো একটি সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়, এর জন্য জাতীয় প্রচেষ্টা দরকার।”

কানিংহ্যাম বলেন, ইউক্রেইনজুড়ে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক ছড়িয়ে আছে।

“আমরা অ্যান্টি-ভেহিকল মাইন দেখেছি, লোহা এবং প্লাস্টিক-দু ধরনেরই। আমরা অ্যান্টি-পারসোনেল মাইনও দেখছি।”

এর বাইরেও আরও বেশ কয়েক ধরনের মাইন দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

বিভিন্ন ধরনের ও মাত্রার বিস্ফোরক থাকায় চ্যালেঞ্জও বেশি উল্লেখ করে দ্য হালো ট্রাস্টের কানিংহ্যাম বলেন, সব সরাতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

“এক দিনের যুদ্ধ মানে কয়েক মাসের বিস্ফোরক সরানোর কাজ,” মন্তব্য করেন তিনি।

যুদ্ধ যেহেতু এখনও চলছে, কর্মীদের সুরক্ষায় তাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরের স্থানে বিস্ফোরক সরানোর কাজ করানো হচ্ছে। তবে এ কাজে নিজেরাই যাতে হাত না দেন, সেজন্য কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কানিংহ্যাম বলেন, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন সরানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অনেকক্ষেত্রে এসব ডিভাইসের নকশা এমনভাবে করা হয় যে, যারা এটি সরাতে হবে যাবে তারা মারা যাবে বা আহত হবে।

তবে এমন সতর্কবার্তায় ওলেক্সান্দর হাব্রিউককে থামাতে পারেনি। এই চাষির ভাষ্য, তার খামার গড়তে জীবন থেকে ২৫ বছর চলে গেছে। সেই খামারকে তিনি নতুন করে সাজাবেন নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য।

“আমার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন ক্ষেত বিস্ফোরকমুক্ত করা।”