কোলাজেনের জন্য ব্রাজিলে বন উজাড়

মাছ, শুকর এবং গবাদি পশু থেকে কোলাজেন সংগ্রহ করা যায়। ব্যবহারকারীদের বিশ্বাস, এই বিশেষ ধরনের প্রোটিন চুল, ত্বক, নখ ও হাড়ের সন্ধি ভালো রাখে। সেই সঙ্গে শ্লথ করে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2023, 04:51 AM
Updated : 23 March 2023, 04:51 AM

ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কোলাজেন উৎপাদনের পেছনের গল্পটি উঠে এসেছে একদল সাংবাদিকের অনুসন্ধানে। এই কোলাজেন বানাতে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহে গড়ে তোলা হচ্ছে গবাদিপশুর খামার, যাতে ধ্বংস হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, একেকটি খামারে হাজার হাজার পশুপালন হচ্ছে। ব্রাজিলের বনভূমি তাতে বিপর্যস্ত।

গার্ডিয়ানের সঙ্গে এই অনুসন্ধানে ছিল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, সেন্টার ফর ক্লাইমেট ক্রাইম অ্যানালাইসিস (সিসিসিএ), আইটিভি এবং ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ও জোইও ই ও ত্রাইগো। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি করা হয়েছে পুলিৎজার সেন্টারের রেইনফরেস্টস ইনভেস্টিগেশন নেটওয়ার্কের সহায়তায়।

গরুর মাংস ও সয়া বাণিজ্যের সঙ্গে বন বিনাশের যোগসাজশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বহু আগে থেকেই। এসবের মধ্যে নজর এড়িয়ে গিয়েছে কোলাজেনের ধুন্ধুমার বাণিজ্য, যা এখন চারশ কোটি ডলার ছুঁয়েছে।

মাছ, শুকর এবং গবাদি পশু থেকে কোলাজেন সংগ্রহ করা যায়। ব্যবহারকারীদের বিশ্বাস, এই বিশেষ ধরনের প্রোটিন চুল, ত্বক, নখ ও হাড়ের সন্ধি ভালো রাখে। সেই সঙ্গে শ্লথ করে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে।

সৌন্দর্য চর্চার ব্র্যান্ডগুলো তো বটেই, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও কোলাজেন ব্যবহার করে।

আন্তর্জাতিকভাবে কোলাজেনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও সরবরাহের কারণে ব্রাজিলের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনে গবাদিপশু পালন বেড়েছে; যা বন নিধনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে বলে উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে।

নেসলের পণ্য ভাইটাল প্রোটিনসেও রয়েছে ওই কোলাজেন। এ ধরনের কোলাজেন সমৃদ্ধ পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বহু জায়গায় বিক্রি হচ্ছে।

হলিউডের অভিনয়শিল্পী জেনিফার অ্যানিস্টন ভাইটাল প্রোটিনসের চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার। তার ভাষায়, “কোলাজেন কাজ করে আঠার মত যা ত্বকের নিচে সবকিছুকে আটকে রাখে।”

জেনিফার অ্যানিস্টন কোলাজেন মেশানো সকালের কফিতে চুমুক দিয়ে আসছেন অনেক বছর ধরেই।

অনেক গবেষণাতেই বলা হচ্ছে, কোলাজেন মুখে সেবন করলে অস্থিসন্ধি ও ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

তবে হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ সাবধান করে বলছে, এসব গবেষণা ও গবেষকের অনেকের পেছনে হয়ত কোলাজেন ইন্ডাস্ট্রির সম্পৃক্ততা রয়েছে।

গার্ডিয়ান লিখেছে, পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব নজরে রাখার বিষয়ে কোলাজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা নেই।

বন বিনাশ নিয়ন্ত্রণে আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের আইনে গরুর মাংস, সয়া, পাম ওয়েল ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনে যে নজরদারির নিয়ম রয়েছে, কোলাজেন তার বাইরে রয়ে গেছে।

যদিও নেসলে বলছে, তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির সঙ্গে এসব অভিযোগ একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ঘটনা তদন্ত করে দেখতে সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও জানিয়েছে এই কোম্পানি।

নেসলের ভাষ্য, তাদের পণ্য উৎপাদনে যাতে বন বিনাশ না হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে তা নিশ্চিত করবে তারা।

বোভিন কোলাজেনকে বলা হচ্ছে গবাদি পশু পালন বাণিজ্যের ‘উপজাত’ পণ্য। ব্রাজিলে অ্যামাজন বনের যে অংশ ধ্বংস হয়েছে, তার ৮০ শতাংশের জন্য এই গবাদি পশুর বাণিজ্যকে দায়ী করা হচ্ছে।

তবে অনেকের মতে, ‘উপজাত’ শব্দটি এখানে বিভ্রান্তিকর, জবাই করা একটি গরু থেকে মাংস বাদে চামড়া, কোলাজেনসহ যা যা পাওয়া যায়, তার ওজন ওই গরুর প্রায় অর্ধেক। আর ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারের তথ্য অনুযায়ী, এসব পণ্যই খামারের আয়ের ২০ শতাংশের যোগান দিতে পারে।

গরুর মাংস, চামড়া ও কোলাজেনের বাড়ন্ত চাহিদার বিপরীতে দিন দিন বনভূমি সাফ হচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠছে গবাদি পশু পালনের খামার। অধিকাংশ জমিই বেআইনিভাবে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

গরুর মাংস প্রক্রিয়াজাতকারীরা পরিবেশের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন কি না তাতে নজরদারি করেন ব্রাজিলের প্যারা রাজ্যের ফেডারেল প্রসিকিউটর রিকার্ডো নেগ্রিনি।

তিনি মনে করছেন, বন ধ্বংস করে গড়ে ওঠা খামারের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই সর্বশেষ পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির সরাসরি যোগাযোগ পাওয়া যাবে না, কারণ গবাদিপশু পালনে বিভিন্ন ধাপে প্রায়ই এক খামার থেকে অন্য খামারে নেওয়া হয়।

বন কেটে বানানো খামারে জন্ম নেওয়া গরুটি হয়ত মোটাতাজা হচ্ছে অন্য একটি খামারে, যাকে পরিবেশের ক্ষতি করা বা নিয়ম ভঙ্গের জন্য সরাসরি দায়ী করা যায় না। তবে যে গবাদি পশুটি কেনা হচ্ছে, তার উৎস শনাক্ত করার মত সক্ষমতা মাংস উৎপাদক সব কোম্পানিরই রয়েছে বলে নেগ্রিনির ভাষ্য।