১৬ দিন ধরে মাটির নিচে অন্ধকারে আটকা পড়ে থাকা ৪১ শ্রমিককে অবশেষে একে একে বের করে আনা হল।
Published : 28 Nov 2023, 07:38 PM
ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশীতে ধসে পড়া সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে মাটির নিচে অন্ধকারে আটকা পড়ে থাকার ১৭ দিনের দিন অবশেষে মুক্তি মিলল ৪১ শ্রমিকের। প্রথমেই বের করে আনা হয় দুই শ্রমিককে। এরপর বাকিদেরকেও একে একে বের করে এনেছেন উদ্ধারকারীরা।
উত্তরাখন্ড রাজ্য সরকার এক বিবৃতিতে ৪১ জন শ্রমিকেরই মুক্তি পাওয়ার খবর জানিয়ে ‘গোটা দেশের জন্যই এ এক সুসংবাদ’ বলে প্রশংসা করেছে।
ওদিকে, উদ্ধারকর্মীদের কাজের প্রশংসার পাশাপাশি উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকদের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, “সুড়ঙ্গে যারা আটকে ছিলেন সেইসব বন্ধুদের বলতে চাই, আপনাদের সাহস এবং ধৈর্য্য প্রত্যেকের জন্যই অনুপ্রেরণাদায়ক।”
প্রথম শ্রমিক সুড়ঙ্গ থেকে বেরোনোর খবর আসতেই বাইরে অপেক্ষমান সবার মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রথম ছবি প্রকাশ করেন ঘটনাস্থলে থাকা বিবিসি’র এক সাংবাদিক। তাতে দেখা যায়, উদ্ধার পাওয়া এই শ্রমিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুস্কার ধামী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভিকে সিং।
মঙ্গলবার সুড়ঙ্গে ম্যানুয়াল ড্রিলিংয়ের কাজ শেষ হওয়ার পরই এলাকায় দেখা যায় উদ্ধার তৎপরতা৷ সুড়ঙ্গের ভেতরে স্ট্রেচার নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরই শ্রমিকদেরকে একে একে বের করে আনার কাজ শুরু হয়।
৯০ সেন্টিমিটার (তিন ফুট) ব্যাসের একটি পাইপ দিয়ে শ্রমিকদেরকে স্ট্রেচারে করে বের করে আনা হয়েছে। সুড়ঙ্গের ধ্বংস্তপের ভেতর দিয়ে এই পাইপ ঢুকানো হয়। শ্রমিকদেরকে বের করতে সুড়ঙ্গের ধসে পড়া অংশে পৌঁছান রাজ্য এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
বদ্ধ সুড়ঙ্গে টানা ১৭ দিন আটকে ছিলেন শ্রমিকেরা। গত ১২ নভেম্বর ভোরে সুড়ঙ্গে ধস নেমে তারা আটকে পড়েন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা গেলেও উদ্ধার করা যাচ্ছিল না।
সুড়ঙ্গে ধস নেমে ৬০ মিটার ধ্বংসস্তূপের পিছনে আটকে ছিলেন শ্রমিকেরা। যন্ত্রের মাধ্যমে সেই ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাধা আসছিল বার বার।
কখনও সুড়ঙ্গে ধস নেমে, কখনও যন্ত্র খারাপ হয়ে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়েছিল। গত শুক্রবার আমেরিকান খননযন্ত্রটি ধ্বংসস্তূপের ভিতরে লোহার কাঠামোয় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায়।
যন্ত্রটি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তা আর মেরামত করা যায়নি। ফলে থমকে যায় উদ্ধারকাজ। ওই ২৫ টন ওজনের ভাঙা যন্ত্রের অংশগুলি বার করাই উদ্ধারকারীদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অবশেষে সোমবার যন্ত্রাংশ বার করে আনা হয়। সুড়ঙ্গে এর পর নামেন খনি শ্রমিকেরা। ঠিক হয়, আর যন্ত্র নয়, এ বার অন্য পদ্ধতিতে ধ্বংসস্তূপ খোঁড়া হবে। পরে নিষিদ্ধ পদ্ধতিতেই আসে সাফল্য। যে পদ্ধতির নাম ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ বা ‘ইঁদুর গর্ত কৌশল’।
যেভাবে সম্পন্ন হয়েছে চূড়ান্ত দফা খনন কাজ:
সুড়ঙ্গ আর মাত্র ১০/১২ মিটার খোঁড়া গেলেই পৌঁছে যাওয়া যেত আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে। সে অবস্থায় গত শুক্রবার ভেঙে যায় খনন কাজে ব্যবহৃত বিশাল আকারের অগার মেশিনটি। থমকে যায় উদ্ধারকাজ।
সুড়ঙ্গের মধ্যে ধসে যাওয়া মাটি–পাথর–লোহার কাঠামোয় আটকে গিয়ে মেশিনের রোটারি ব্লেডগুলো এমন ভাবে ভেঙে যায় যে সেটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে। এমনকি মেশিনটি আর মেরামত করাও সম্ভব না বলে জানিয়ে দেন উদ্ধারকর্মীরা। বরং মেশিনের ভাঙা টুকরোগুলো ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করা না গেলে নতুন করে উদ্ধারকাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছিল না।
পরে হায়দরাবাদ থেকে বিশেষ ধরনের গ্যাস কাটার এনে অগার মেশিনটির ভেঙে যাওয়া টুকরাগুলো কেটে বের করে আনা হয়। ভাঙা টুকরোগুলি সব বার করার পর সোমবার থেকে আবার সেখানে খননকাজ শুরু হয়। তবে এবার হাত দিয়ে খনন শুরু হয়। প্রয়োগ করা হয় ‘ইঁদুর গর্ত কৌশল’।
নাম শুনেই আন্দাজ করা যায়, ইঁদুরের কায়দায় গর্ত খোঁড়ার সঙ্গে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর সম্পর্ক রয়েছে। কয়লাখনিতে অতি ক্ষুদ্র কিছু গর্ত খুঁড়ে কয়লা উত্তোলন করার প্রক্রিয়াকে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ বলে। এ প্রক্রিয়ায় চার ফুটের বেশি গভীর গর্ত খোঁড়া হয় না।
খনি থেকে আকরিক উত্তোলন, বিশেষত কয়লাখনির কাজে এই ‘ইঁদুর গর্ত কৌশল’ পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। কিন্তু পরে তা নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ, এ পদ্ধতিতে মূল ঝুঁকির কারণ হল, সুড়ঙ্গ অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়। ফলে যে কোনও মুহূর্তে ধস নেমে শ্রমিকের মৃত্যু হতে পারে।
নিষিদ্ধ এই পদ্ধতিতে ভরসা রেখেই শেষমেশ সাফল্য মিলেছে উদ্ধারকাজে। সোমবার থেকে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ শুরু হয়। ইঁদুর গর্ত কৌশলে’ খননে পারদর্শী প্রায় দুই ডজন শ্রমিক হাতের সাহায্যে গাঁইতি, হাতুড়ি, শাবল দিয়ে সুড়ঙ্গের শেষ অংশটুকু খোঁড়া শুরু করেন।
‘ইঁদুরের গর্ত’ খোঁড়ার প্রথম ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসে মঙ্গলবার। ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই সেই ভিডিও পোস্ট করে । তাতে দেখা যায়, চার জন শ্রমিক কাজ করছেন।
তাদের মধ্যে তিন জন একটি পাইপের ভিতর থেকে বেরিয়ে থাকা দড়ি টানছেন। আর চতুর্থ জন পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সেদিন সকালে আরো বলা হয়, আর মাত্র পাঁচ মিটার খুঁড়তে পারলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে শ্রমিকদের কাছে। সেদিন দুপুরের পর আসে সাফল্যের খবর। জানানো হয়, সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শেষ। এবার শ্রমিকদের বের করে আনার পালা।
সুড়ঙ্গ খোঁড়ার এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুড়ঙ্গ বিপর্যয় মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স। সপ্তাহখানেক আগে ভারত সরকার অস্ট্রেলীয় এই বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসে।
যেভাবে আটকা পড়েছিলেন শ্রমিকরা:
গত ১২ নভেম্বর স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলায় ব্রহ্মখাল- যমুনাত্রী জাতীয় মহাসড়কের অংশে নির্মাণাধীন একটি টানেলের কিছু অংশ ধসে পড়ে কিছু শ্রমিক আটকা পড়েন। পরে জানা যায়, আগের রাতে সেখানে ৫০ থেকে ৬০ শ্রমিক প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার|
দীর্ঘ ওই হাইওয়ে টানেলটির নির্মাণ কাজ করছিল। টনেল ধসের দুইদিন পর স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, যারা টানেলটির বের হয়ে যাওয়ার মুখের কাছে কাজ করছিলেন তারা ধসের পর বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। তবে ৪০ শ্রমিক, যারা ভেতরে কাজ করছিলেন তারা আটকে পড়েন। আরো পরে জানানো হয়, ৪০ নয় বরং ৪১ জন শ্রমিক আটকা পড়েছেন।
যে সুড়ঙ্গটি ধসে পড়েছে সেটি উত্তরাখণ্ড রাজ্যে একটি জাতীয় মহাসড়কে নির্মিত হচ্ছে, যা চারধাম হিন্দু তীর্থযাত্রা পথের অংশ। ধসে পড়া টানেলটি উত্তরাখণ্ডের উত্তর কাশীর সিল্কিয়ারাকে দন্দলগাঁও এর সঙ্গে সংযুক্ত করবে। যার ফলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান উত্তর কাশীর থেকে যমুনাত্রী ধামের মধ্যেবর্তী সড়ক পথের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার কমে যাবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর একটি এই চারধাম হাইওয়ে। যার লক্ষ্য উত্তরাখণ্ডে হিন্দুদের চারটি তীর্থস্থানকে জুড়ে দেওয়া। ৮৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কটি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ভারতের পাহাড়ি রাজ্য উত্তরাখণ্ডে প্রায়ই ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। এটি ভূমিকম্প এবং বন্যা প্রবণ এলাকাও বটে। তার মধ্যে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণেই টানেল ধসের এই ঘটনা ঘটেছে বলে সে সময় মত প্রকাশ করেছিলেন ভূতত্ত্ববিদ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালে টানেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০২২ সালের জুলাই মাসে সেটির নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। পরে তা পিছিয়ে ২০২৪ সালের মে মাস করা হয়েছে।
যেভাবে শুরু হয় উদ্ধার কাজ:
টানেলটি যেদিন ধসে পড়ে সেই দিন সকাল থেকেই একটি পাইপের মাধ্যমে শ্রমিকদের কাছে খাবার, পানি ও অক্সিজেন পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
এক্সেকোভেটর এবং অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রথমে টানেলের ধসে পড়া অংশের মুখে থাকা কংক্রিটের আবর্জনা সরিয়ে ফেলা হয়। প্রায় ২০
মিটারের মত অংশের আবর্জনা সরিয়ে ফেলার পর বাকি আরো প্রায় ৩৫ মিটার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শুরু হয় খনন কাজ।
গত ১৫ নভেম্বর থেকে বিশালাকারের বিশেষায়িত একটি ড্রিল মেশিন দিয়ে মাটি গর্ত করে তারপর সেই গর্ত দিয়ে মাটির ভেতর বড় পাইপ ঢুকিয়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল।
কিন্তু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকা কংক্রিটের বিশাল বিশাল বোল্ডার ও স্লাবের কারণে ড্রিল মেশিনটি বার বার আটকে যাওয়ায় সেই প্রচেষ্টা বাদ দিতে হয়। ড্রিলের কারণে নতুন করে ধসের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছিল।
টানেল ধসে পড়ার পর প্রথম সুখবরটি আসে গত ২০ নভেম্বর। ওই দিন আবর্জনা খুঁড়ে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের নতুন একটি পাইপ ভেতরে পাঠানো হয়, পরে ওই পাইপের মধ্য দিয়ে একটি মেডিকেল এন্ডোস্কোপিক ক্যামেরা পাঠিয়ে ভেতরে থাকা শ্রমিকদের ভিডিও ধারণ করা হয়।
ওই ভিডিও প্রকাশের পর প্রথমবার সব অস্বস্তি কাটিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে আটকে পড়া শ্রমিকরা ভালো আছেন। ওই পাইপ দিয়ে প্রথমবারের মত তাদের জন্য গরম খাবারও পাঠানো হয়।