করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রীর মুখে দুর্ঘটনার বয়ান

কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী এই ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে উড়িষ্যায়; নিহত হয়েছে দুই শতাধিক।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2023, 03:33 AM
Updated : 3 June 2023, 03:33 AM

“মুহূর্তের মধ্যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার গায়ে তখন এসে পড়েছে আরও কয়েকজন। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বুঝলাম, আমাদের কামরাটি উল্টে গিয়েছে পুরো। দুর্ঘটনায় পড়েছি,” বলছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী কৃষ্ণপদ মণ্ডল।

কলকাতা হাওড়া থেকে দ্রুতগামী এই ট্রেনে উঠেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই বাঙালি। যাচ্ছিলেন চেন্নাই। তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় উড়িষ্যায় বালেশ্বরে দুর্ঘটনায় পড়ে ট্রেনটি। তাতে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন হাজার খানেক মানুষ।

তবে এই দুর্ঘটনায় বেঁচে গেছেন কৃষ্ণপদ এবং তার চাচা প্রশান্ত মণ্ডল; কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা খুঁজে পেয়েছে তাদের, জেনেছে তাদের অভিজ্ঞতা।

কোয়েম্বত্তূরে কাজে যোগ দিতে যাওয়ার উদ্দেশে শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপেছিলেন কৃষ্ণপদ। কাকার সঙ্গে ছিলেন স্লিপার কোচে। দুজনেই মার্বেল পাথরের কাজ করেন। শনিবার রাতে তাদের চেন্নাই পৌঁছার কথা। ট্রেন চলার সঙ্গে সহযাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা ও গল্পগুজবও চলছিল অন্য সময়ের মতো।

কৃষ্ণপদ বলেন, “উড়িষ্যার বালেশ্বর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। হাওড়া থেকে বোতলে যে ঠাণ্ডা জল ভরে ট্রেনে উঠেছিলাম, খড়্গপুর পেরোতেই তা শেষ। তাই বালেশ্বর স্টেশনে নেমে বোতলে জল ভরে নিই। সহযাত্রীদেরও কয়েকটি বোতলে জল ভরি। তার পর আবার ট্রেনে উঠে যাই। কিন্তু নিজের আসনে না ফিরে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম দু-চারজনের সঙ্গে।”

Also Read: উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২০০ ছাড়াল, বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চালু কলকাতায়

সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুর্ঘটনায় পড়ে ট্রেনটি, তখনও কৃষ্ণপদ দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন।

তার ভাষ্যে, “হঠাৎই বিকট একটা ঝাঁকুনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কামরা এক দিকে হেলে পড়তে থাকে। এস ৪ কামরা এতটাই কাত হয়ে যায় যে খোলা দরজা গলে বাইরে পড়ে যান দু-তিন জন। ওদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বুঝতে পারছি, আমিও হেলে পড়ছি খোলা দরজার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোহার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়। আমি গিয়ে পড়ি সেই দরজার উপর। এক মুহূর্ত আগে পড়লে আমিও ট্রেন থেকে বাইরে পড়ে যেতাম। কী বাঁচা যে বেঁচেছি, তা শুধু আমিই জানি।

“সেই মুহূর্তে চার দিক থেকে কেবল চিৎকার আর আর্তনাদের শব্দ। হঠাৎ খেয়াল হল, কাকা কোথায়? খুঁজতে যে যাব, তারও উপায় নেই। কাঁধে, হাতে, পায়ে, কপালের কোণে চোট পেয়েছি। আর যে ভাবে পড়ে আছি, একা ওঠার সাধ্য নেই।”

দুর্ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, তা অনুযায়ী করমণ্ডল এক্সপ্রেস পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি মালগাড়িকে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি মালগাড়ির উপরে উঠে যায়। ২৩টি বগির মধ্যে ১৫টি লাইন থেকে ছিটকে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে। সেই লাইন দিয়ে তখন আসছিল বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিগুলো গিয়ে পড়ে সেই লাইনের উপর। বেঙ্গালুরু-হাওড়া ট্রেনটির দুটি কামরাও তখন লাইনচ্যুত হয়।

কৃষ্ণপদ বলেন, “এভাবেই কাটল কিছু ক্ষণ। এর মধ্যে আমাদের কামরা বেশ কয়েক বার দুলে ওঠে। তাতে ভয় আরও বাড়ে। সেই সময় আরও কয়েকটি কান ফাটানো আওয়াজ শুনেছিলাম। জানি না কোথা থেকে আসছিল। বেশ কিছুক্ষণ মরার মতো পড়ে ছিলাম সেখানেই। তারপর শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। ততক্ষণে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেকেই দেখলাম মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দৌড়াচ্ছেন আর চিৎকার করছেন- বাঁচাও, বাঁচাও। কী করব, কোথায় যাব কিছুই মাথায় আসছে না। সত্যি বলতে কী, বুঝেই উঠতে পারছি না, সত্যিই কি বেঁচে আছি?

“কোনোমতে উঠে দাঁড়াই উল্টে পড়া কামরায়। তার পর টলতে টলতে কামরার ভিতর দিকে ঢুকতে চেষ্টা করি। কাকা কোথায়? অন্ধকারে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। কাকা-কাকা বলে বার কয়েক ডাকলাম কিন্তু সাড়া পেলাম না। গোটা কামরায় তখন চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। অন্ধকারে কিছুই ভাল মতো দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় কাকাকে দেখতে পেলাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন! কাকা বলল, তারও পায়ে চোট লেগেছে, কিন্তু প্রাণে বেঁচে আছে দেখে একটু যেন নিশ্চিত হলাম।”

কীভাবে বের হলেন, তার বর্ণনায় কৃষ্ণপদ বলেন, “এবার কাকাকে নিয়ে কামরা ছেড়ে বেরোতে হবে। অনেকেই আমার মতো বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করছেন। আমাদের সঙ্গে থাকা মালপত্রের মায়া ত্যাগ করে তাদের দেখাদেখি আমরা দুজনও কোনো রকমে কামরা ছেড়ে বাইরে বেরোই। আর বেরিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুহূর্তে হিম হয়ে গেল! চার দিকে ছড়ানো ট্রেনের বিশাল বিশাল সমস্ত কামরা। কোনোটা মালগাড়ির উপরে ঝুলছে। কোনো কামরা আবার অন্য কামরার তলায় ঢুকে গেছে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে দেহাংশ। তত ক্ষণে আশপাশের লোকজন আসতে শুরু করেছেন। উদ্ধারকাজ শুরু করে দিয়েছেন ট্রেনের যাত্রীরা। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই ভালো দেখা যাচ্ছে না।

বেরিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুহূর্তে হিম হয়ে গেল! চার দিকে ছড়ানো ট্রেনের বিশাল বিশাল সমস্ত কামরা। এখানে ওখানে ছড়িয়ে দেহাংশ
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী কৃষ্ণপদ মণ্ডল

“কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে চোখ সয়ে গেল। অনেকটাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুঝলাম, এস ৩ এবং এস ২ কামরা দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমাদের সংরক্ষিত কামরাগুলোর আগে ছিল অসংরক্ষিত কামরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই অসংরক্ষিত কামরাগুলোই। ওই কামরাগুলোতে যে কত মানুষের প্রাণ গেছে, ভাবতেও পারছি না।”

ট্রেন থেকে বেরিয়ে আসার পর হতাহতদের উদ্ধারে নেমে পড়েন কৃষ্ণপদ ও তার কাকা।

“কাকার সঙ্গে আমিও নেমে পড়লাম উদ্ধারে। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে হাত নড়ছিল না। মুখ দিয়ে কথাও ফুটছে না। বাপের জন্মেও এমন দৃশ্য দেখিনি আমি। কাকারও একই অবস্থা।

বেশ কিছুক্ষণ পর রেলের লোকজন পৌঁছায়। চারপাশ থেকেই অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ পাচ্ছিলাম গোটা সময় ধরে। কাকার মাথা ঘুরছিল। একটু ফাঁকা একটি জায়গায় কাকাকে নিয়ে গিয়ে বসাই। তারপর সেখানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এসে আমাদের হাতে জল তুলে দেয়। কিছু বিস্কুটও কেউ এনে দিল হাতে।”

শনিবার সকালেও সেখানে উদ্ধার কাজ চলছিল। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।