Published : 30 Oct 2024, 01:17 AM
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। জরিপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস নিয়ে হোয়াইট হাউজের দৌড়ের শেষ দিনগুলোতে পদার্পণ করেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস।
এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হন আর তার কী প্রভাব ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং মহাদেশের নিরাপত্তায় পড়ে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপ।
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালেক্সান্ডার স্টাব রয়টার্সকে বলেন, আমরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। কারণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই নির্বাচনের একটা প্রভাব আছে।
ইউক্রেইন এবং ইউরোপের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ এলে, অনেক ইউরোপীয় কর্মকর্তাই বলেন যে, তারা রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আবার ক্ষমতায় আসা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
কারণ, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির আমলে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক টালমাটাল ছিল। তিনি পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেইনের লড়াই নিয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি দোদুল্যমান ছিল।
ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেইন যুদ্ধের কোনওরকম অবসান, যাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জয় হিসাবেই দেখেন.. সেই যুদ্ধের অবসানে তিনি নেটো দেশগুলোকে আক্রমণ করতে উৎসাহী হয়ে উঠতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এই দশক শেষেই রাশিয়া এমন কিছু করে বসার অবস্থায় চলে যেতে পারে বলে এ মাসে সতর্ক করেছেন জার্মানির এক গোয়েন্দা প্রধান। যদিও পুতিন বরাবরই নেটো দেশগুলোতে হামলা চালানোর কোনওরকম অভিপ্রায় থাকার কথা অস্বীকার করে আসছেন।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে রয়টার্স ইউক্রেইন পরিস্থিতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রভাব নিয়ে ২০ জনেরও বেশি ঊর্ধ্বতন ইউরোপীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মিত্রর সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলেছেন।
তাদের সবারই মন্তব্যে মুল যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে: অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে যার সম্পর্কে আগে থেকে কিছু আঁচ করা যায় না সেরকম কেউ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে থাকলে এই অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়, যেমনটি ছিল ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২১)।
চলতি মাসে ট্রাম্প ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেই যুদ্ধ শুরুর জন্য দায়ী করেছেন। যদিও ইউক্রেইনে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে।
ট্রাম্প বলেছেন, আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে জিতলে একদিনেই তিনি ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। সেটি এমনকি তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেও হতে পারে। তবে তিনি কীভাবে সেটি করবেন তা বলেননি। আবার ইউক্রেইনকে সাহায্য করতে চান না এমন কথাও ট্রাম্প বলেননি।
অন্যদিকে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জয়ী হলে ইউক্রেইনকে সমর্থন দেওয়ার নীতি অব্যাহত রাখবেন, আবার উত্তেজনা বৃদ্ধিও এড়িয়ে চলবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তীব্র সমালোচক কমলা হ্যারিস। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জিতলে যুদ্ধে ইউক্রেইনের হাতই শক্তিশালী রাখা এবং ন্যায়সঙ্গত শান্তি অর্জন নিশ্চিত করার জন্য তিনি কাজ করবেন। যদিও তিনি ইউক্রেইন নিয়ে বিস্তারিত কোনও পরিকল্পনা এখনও করেননি।
ইউক্রেইন ও মিত্রদের জন্য কঠিন সময়:
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন উক্রেইন ও এর ইউরোপীয় সমর্থকরা একটি কঠিন সময় পার করছে।
মস্কোর সেনাবাহিনী পূর্ব ইউক্রেইনে লড়াইয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ইউক্রেইনের জ্বালানি অবকাঠামো তুমুল রুশ হামলায় তছনছ হওয়ার পর সামনে আসছে শীতের এক কঠিন সময়।
ইউরোপের দেশগুলোতেও অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি মহাদেশজুড়ে সরকারি আর্থিক খাতের অবস্থা টনটান। রাশিয়া-বান্ধব জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সম্প্রতি কয়েকমাসে অস্ট্রিয়া, পূর্ব জার্মানি এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভাল ফল করেছে।
নেটো জোটের একটি দেশের এক কূটনীতিক বলেছেন, “যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে ততই ইউক্রেইনকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য কঠোরভাবে কাজ করতে হবে। কারণ, অনেকেই তখন বলতে থাকবে আমরা কেন এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছি? এ যুদ্ধ এক বিশাল পেষণযন্ত্র।”
সেরকম ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ নীতির যে কোনও পরিবর্তন ঘটে গেলে প্রধান যে পদক্ষেপটি ইউক্রেইনের জন্য সহায়ক হতে পারে বলে ইউরোপ আশা করছে তা হল: রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদের মুনাফা কাজে লাগানো।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার জব্দ করা আর্থিক সম্পদ থেকে যে আয় হচ্ছে তা থেকে ইউক্রেনকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে গত জুনেই সম্মত হয়েছিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭।
ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য জি-৭ এই অর্থ দিতে রাজি হয়। গত সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বোঝাপড়া হয়েছে। এই চুক্তির ফলে ভবিষ্যতে ইউক্রেইনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমলেও ইউক্রেইন এই অর্থ দিয়ে অস্ত্র কিনতে পারবে।
পশ্চিমা এক কর্মকর্তা বলেন, “জি-৭ এর এই ৫০ বিলিয়ন ডলার (৫ হাজার কোটি ডলার) ইউক্রেইনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেইন ২০২৫ সালের জন্য সত্যিই ভালভাবে তৈরি হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।”
তবে কেবল এটিই নয়, এর পাশাপাশি ইউক্রেইনকে সমন্বিতভাবে সহায়তা দেওয়ার জন্য নেটো জোট একটি কমান্ডও প্রতিষ্ঠা করছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বিশেষ কোয়ালিশনের কাছ থেকে বেশির ভাগ কাজের দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছে তারা।
যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, নেটো সামরিক কাঠামোর আওতায় তাদের এই প্রচেষ্টা হঠাৎ কোনও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারলেও নেটো জোটে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থাকায় এ চেষ্টা কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে সংশয় আছে।
ট্রাম্প আবেদন:
জনসম্মুখে বক্তব্যে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ট্রাম্প ও তার সমর্থকদেরকে একথাই বোঝানোর চেষ্টা নিয়েছেন যে, ইউক্রেইনের যুদ্ধে পুতিন জয় পেলে তা যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল প্রতিপন্ন করবে এবং আমেরিকার শক্তিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহী হয়ে উঠবে রাশিয়া এবং চীন।
ওদিকে, নেটো মহাসচিব মার্ক রুত্তে এ মাসে ট্রাম্পের অনুকূলে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, “ট্রাম্প মনে করেন যুদ্ধটা কেবল ইউক্রেইনের বিষয় নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও সুরক্ষারও বিষয়।”
ট্রাম্প এবং হ্যারিস দুইজনই সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে দেখা করেছিছিলেন।
জেলেনস্কি প্রকাশ্যে এই দুই প্রার্থীর কারও অনুকূলেই কথা বলেননি। তবে বৈঠকের পর তিনি বলেছিলেন, “আমেরিকার সরাসরি ইউক্রেইন নিয়ে একটি বোঝাপড়া আছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আর যুদ্ধ অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে বন্ধ হতে হবে, যাতে কোনও আগ্রাসী শক্তি কখনও এমন করতে না পারে, যা আজ রাশিয়া করছে।”
ওদিকে, ইউরোপীয় সব দেশের নেতাই যে ট্রাম্পকে নিয়ে উদ্বিগ্ন তা নয়। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবার্ন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিত্র। ট্রাম্পের মতো তিনিও ইউক্রেইনকে সামরিক সহায়তা করার বিরোধী। ট্রাম্প যে তার মতো একই মত পোষণ করেন সে বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলেছেন ওরবার্ন।
আবার এর বিপরীতে কিছু ইউক্রেইনীয় ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর কর্মকর্তাদের ধারণা, ট্রাম্পের প্রস্তাব করা কোনও চুক্তি রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করলে বা ফিরিয়ে দিলে তিনি বাইডেনের নির্ধারিত সীমাও ছাড়িয়ে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প ইউক্রেইনকে আরও দূর-পাল্লার অস্ত্র দিতে পারেন এবং রাশিয়ার ভূখন্ডের অনেক ভেতরে হামলা চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিতে পারেন।