শহরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও আর তিল ধারণের জায়গা নেই।
Published : 27 Jul 2024, 02:32 PM
ইসরায়েলি বাহিনীর গোলার আঘাতে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শহর খান ইউনিসের ইয়াসমিন আল-দারদাসি নামের এক নারী হারিয়েছেন তার মাথার ওপরের ছাদ। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে পুরো একটি দিন ও রাত রাস্তার পাশে গাছের নিচে কাটানোর পর তিনি আশ্রয় নিয়েছেন শহরের একটি পরিত্যক্ত কারাগারে, তবে তার জানা নেই সেখানেও কতদিন নিরাপদে থাকা যাবে।
রয়টার্স লিখেছে, দারদাসির মত বোমা হামলায় ঘরবাড়ি হারানো শতাধিক মানুষ এখন আশ্রয় নিয়েছেন একসময় চোর, খুনিসহ কুখ্যাত অপরাধীদের জন্য তৈরি করা ওই কেন্দ্রীয় সংশোধন ও পুনর্বাসনকেন্দ্র।
শহরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও আর তিল ধারণের জায়গা নেই। তাই কয়েদিদের থাকার এই জায়গাই এখন শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছে ঘরবাড়ি হারানো মানুষদের।
গাজার উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালানোর সময় সেখানকার বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। প্রাণে বাঁচতে তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন খান ইউনিসে। গত সপ্তাহের মাঝামাঝিতে গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরটি ঘিরে ফেলার কথা জানায় ইসরায়েলি সেনারা। এরপর সেখানকার পাঁচ লাখ বাসিন্দাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর শুরু হয় বোমাবর্ষণ, বোমার আঘাত থেকে রেহাই মেলেনি কিছু শরণার্থী তাঁবুরও। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে আসা ভিডিওতে দেখা গেছে, বাস্তুচ্যুত বহু মানুষ পরিবারের আহত সদস্যদের নিয়ে বসে আছেন রাস্তার পাশে। গাড়ি, ট্রাক বা পিকআপে করে যে যেভাবে পেরেছেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। এছাড়া লোকজনকে হেঁটেও এলাকা ছাড়তে দেখা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই না মেলায় শহরের এক পাশের ওই কারাগারে আশ্রয় নিয়েছেন শরণার্থীরা। যা নির্মাণ করা হয়েছিল চোর-ডাকাত-খুনিদের আটকে রাখার জন্য।
কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর অনেক আগেই কারাগার থেকে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। কারাগার ভবনের দেওয়ালও বুলেটের আঘাতে হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। ওই পরিত্যক্ত কারাগারেই এখন ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ঈঁদুরের মতো তাড়া খেয়ে বেড়ানোর শরণার্থীরা ঢুকছেন দলে দলে।
বাড়ি হারানো দারদাসি কাঁদতে কাঁদতে রয়টার্সকে বলেছেন, তার স্বামী ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছেন অনেকদিন ধরে।
“কোথাও জায়গা পাইনি অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে থাকার জন্য। বাড়িতে বোমা পড়ায় আমার সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, কিছুই সঙ্গে নিয়ে বের হতে পারিনি। কারাগারে নামাজ পড়ার ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। অন্তত সূর্যের প্রখরতা থেকে তো বাঁচতে পেরেছি। কিন্তু এতটুকুই পেয়েছি। অনেকের এই আশ্রয়টুকুও জোটেনি।”
নতুন করে থাকার জন্য কোনো ঘর তৈরিতে রাজি নন এই নারী। তার মত শহরের আরো অনেক বাস্তুচ্যুতই ফের হামলার আশঙ্কায় বাড়িঘর তৈরি করতে চান না বলে জানিয়েছেন দারদাসি।
কারাগারে আশ্রয় নেওয়া খান ইউনিসের আরেক বাসিন্দা সারিয়া আবু মুস্তাফা জানান, ইসরায়েলি বাহিনী তাদেরকে দ্রুত এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
“বৃহস্পতিবার ট্যাংক দ্রুত আমাদের বাড়ির কাছে চলে আসে। আমাদের পোশাক পাল্টানোর মত সময়ও ছিল না। বাড়িতে নামাজ পরার পোশাকে ছিলাম আমরা। ওই অবস্থাতেই বাড়ি ছাড়ি। সঙ্গে কিছুই আনতে পারিনি।”
মুস্তাফা জানান, বাড়ি ছাড়ার পর পরিবারের নারী-শিশুদের নিয়ে প্রথম রাতটি তার কাটে খোলা আকাশের নিচে মাটিতে। যেখানে খাবার তো দূরের কথা খাবার পানিও পাওয়া যায়নি।
সারিয়া আবু মুস্তাফা তার ভাতিজিকে কোলে নিয়ে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন। যুদ্ধের মধ্যেই এই শিশুর জন্ম হয়েছে। যুদ্ধে শিশুটি হারিয়েছে তার বাবা ও ভাইকে।
তবে এই কারাগারে আশ্রয় নেওয়া সবারই ভয়, সেখান থেকেও যেকোনো দিন উচ্ছেদ হতে পারেন তারা।
ওই কারাগারে আশ্রয় নেওয়া হানা আল-সাইয়েদ আবু মুস্তাফা নামের আরেক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় তাকে গত নয় মাসে ছয়বার আশ্রয়হারা হতে হয়েছেন।
তিনি বলেন, “কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসর অনেক দিন থেকে বলে আসছে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছে গেছে। জানিনা তারা এই কাজটি করতে পারবে কী না। যুদ্ধ থামানো সম্ভব না হলে আরো বহুবার ফিলিস্তিনিদের ঘরছাড়া হতে হবে।”
হতাশ কণ্ঠে এই ফিলিস্তিনি বলেন, “আমার জানা নেই, এরপরে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের আগামীতে কোথায় যাওয়া উচিত তাও জানিনা। কারণ যেখানেই আশ্রয় নেই, কিছুদিন পর সেই জায়গাটিই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।”
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ গড়িয়েছে নয় মাসে। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ইসরায়েলে হামাস হামলা চালালে শুরু হয় সংঘাত।
ইসরায়েলের তথ্য অনুযায়ী হামাস অক্টোবরের ওই হামলায় ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করেছে। জিম্মি করে আড়াই শতাধিক মানুষকে।
ওইদিন থেকেই গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজা কর্তৃপক্ষ।
গত ১৩ জুলাই গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৯০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হামাসের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দায়েফকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছিল। এছাড়া বৃহস্পতিবার পূর্ব খান ইউনিসের এলাকায় ইসরায়েলি সামরিক হামলায় ১৪ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। ওই এলাকাটি এখন ধ্বংসস্তুপ।
গাজায় এক মাসের যুদ্ধবিরতি নিয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। লড়াইয়ে বিরতি এবং আরও মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর শর্ত নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সমঝোতায় কয়েক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসর। আর জাতিসংঘ বলছে, গাজায় প্রতি দশজনের মধ্যে নয় জন এখন বাস্তুচ্যুত।