কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৭ এপ্রিল শুরু হওয়া বিক্ষোভ ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে; গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবির পাশাপাশি বেশ কিছু দাবিতে অনড় অবস্থানে শিক্ষার্থীরা।
Published : 27 Apr 2024, 06:02 PM
গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা চালানোর ছয় মাস পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সেই অস্থিরতার মধ্যে ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেমে গেছে এবং গোটা জাতির নজর এখন এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে।
সিএনএন লিখেছে, ক্যাম্পাস অনুযায়ী বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট দাবির ভিন্নতা থাকলেও তাদের মূল দাবি হল ইসরায়েল সংযুক্ত কোম্পানি বা ব্যবসার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক ছিন্ন করা, যেসব কার্যক্রম থেকে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে ইসরায়েল।
যদিও বিক্ষোভকারীদের এই দাবির দিকে টলছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বা বিনোয়োগ বন্ধে তাদের ওপর তেমন কোনো প্রভাব নাও পড়তে পারে।
তবে শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিনিয়োগ চিত্র প্রকাশ করা, ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং গাজায় যুদ্ধবিরতিকে সমর্থনের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভে অনড় রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সিএনএনকে বলেন, “ফিলিস্তিনে চালানো গণহত্যা থেকে যেসব কোম্পানি লাভবান হচ্ছে অথবা তাদের ওপর চালানো নিপীড়নে যেসব ইসরায়েলি কোম্পানি সুবিধা পাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা সেসব কোম্পানির সমস্ত বিনিয়োগ সরিয়ে ফেলতে বলেছি।”
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কর্তৃপক্ষের কাছে বাক স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। সেইসঙ্গে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শাস্তির আওতায় না আনারও দাবি জানাচ্ছেন তারা।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্ষোভের কারণে কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীদের ‘সম্পূর্ণ ক্ষমা’ দাবি করছেন বিক্ষোভকারীরা। ক্যাম্পাসে পুলিশি তৎপরতা বন্ধের দাবিও জানাচ্ছেন তারা।
বৃহস্পতিবার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিক্ষোভকারী জানান, অন্যান্য দাবির পাশাপাশি তারা ‘গণহত্যায় চালানো’ অস্ত্রের ওপর ‘আইভি লিগ’ স্কুলের গবেষণা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
বিক্ষোভকারীরা আরো কিছু দাবি জানাচ্ছেন, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থানীয় বিষয় সম্পর্কিত।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ শুরু হয় ১৭ এপ্রিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানে তাবু গেড়ে বিক্ষোভ শুরু করা শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ‘কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি অ্যাপার্টহেইড ডাইভেস্ট’ এর মতে, নিম্ন আয়ের হারলেমের বাসিন্দাদের আবাসন ও আর্থিক সহায়তার দাবি জানান তারা।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা।
ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে একাডেমিক সম্পর্ক বর্জনের ডাক দিয়েছেন তারা। বিক্ষোভকারীরা চান, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তেল আবিবে তাদের ক্যাম্পাসের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখুক এবং তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বৈত ডিগ্রি প্রোগ্রাম বাতিল করুক।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বিক্ষোভকারীরাও তেল আবিবের ক্যাম্পাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানাচ্ছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হবে?
শিক্ষার্থীরা যে দাবিগুলো জানাচ্ছেন, তার মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলের সম্পর্ক ও বিনিয়োগ বন্ধ করা। প্রায়শই তারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার সঙ্গে এই দাবি তুলে ধরছেন।
বুধবার রিপাবলিকান হাউস স্পিকার মাইক জনসন কলম্বিয়ার শিক্ষার্থীদের সামনে কথা বলার সময় তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘প্রকাশ কর, পরিহার কর (ইসরায়েলের বিনিয়োগ); ‘আমরা থামব না, বিরতি নেব না’।
সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও বাইরে থেকে বড় অনুদান/বিনিয়োগ রয়েছে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার।
আবার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ চলাকালে এই বিনিয়োগকে টার্গেটের পূর্ব ইতিহাসও রয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে বিক্ষোভে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এই বিনিয়োগ সম্পর্ক সফলভাবে ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল শিক্ষার্থীরা।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক চার্লি ইটন বলেন, ইসরায়েল সংযুক্ত বিনিয়োগ বাতিল করবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
“স্কুলগুলো কীভাবে বিনিয়োগ নেবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি অযৌক্তিক কোনো চর্চা নয়। বিনিয়োগ থেকে বড় পরিসরে কী লাভ বা রিটার্ন আসবে তার ওপর ভিত্তি না করে বরং সমতা ও বিচারের ভিত্তিতে বিনিয়োগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।”
কিন্তু ‘একাডেমিক এনগেজমেন্ট নেটওয়ার্ক’ এর চেয়ারম্যান মার্ক ইউডোফ ক্যাম্পাসে ইহুদি বিদ্বেষের বিরোধিতা করে বলেন, এটি বাস্তবায়ন করার মত সহজ সমাধান নয়।
“সত্য হল ইসরায়েলে কে ব্যবসা করছে আর যুদ্ধের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী, তা নির্ধারণ করাই কখনো কখনো দুর্বোধ্য।”
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইউডোফ বলেন, বছরের পর বছর চাপাচাপি সত্ত্বেও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানা নেই।
“ফলে সম্পর্ক ছিন্ন করার মত কিছু ঘটবে বলে আমি মনেও করি না।”
গণগ্রেপ্তার এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শৃঙ্খলা ভঙের কারণে ব্যবস্থা গ্রহণের পরও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ চলছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। বিক্ষোভ থেকে শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত কয়েক দিনে ইয়েল এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে বরখাস্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙের দায়ে ছাত্রত্ব স্থগিত বা বাতিল করার ভয়ও দেখিয়েছে।
বিক্ষোভের পুরো এলাকা জুড়ে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়ছে এবং বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের স্লোগানে লেখা হয়েছে ‘প্রকৃত আমেরিকানরা গাজার পাশে আছে’। আরেকটিতে লেখা ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেনাবাহিনী সরান’, ‘গাজায় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নেই’, ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ইয়েল, এমারসন এবং ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানসহ যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজার পক্ষে বিক্ষোভে এখন উত্তাল।