“তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। একাধারে যেমন প্রচণ্ড পরিশ্রমী, সুদক্ষ প্রশাসক, তেমনি নিজের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তিনি চরম একগুঁয়ে”- ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে এমন মন্তব্য তার জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের।
Published : 17 May 2014, 01:52 AM
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় ভারতের চতুর্দশ প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি, যার পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল রেলস্টেশনে একজন চা বিক্রেতা হিসেবে।
পরবর্তীতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০২ সালে দাঙ্গায় প্রায় সহস্রাধিক মুসলমানের প্রাণহানির ঘটনায় মোদির দিকে অভিযোগের তীর ওঠে। আদালতের রায়ে তিনি খালাস পেলেও তা হয়নি জনতার রায়ে।
তারপরও সেই মোদিকে সামনে রেখে দিল্লির হারানো মসনদ করায়ত্ত করার পরিকল্পনা নেয় বিজেপি, আর ফলাফল প্রমাণ করল যে তারা সফল হয়েছে।
‘এক ভারত-অভিন্ন ভারত’ স্লোগানকে সামনে রেখে লোকসভা নির্বাচন প্রচারাভিযান শুরু করা এনডিএ জোটের প্রধান শরিক বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক জীবন একাধারে যেমন বর্ণময়, তেমনি বিতর্কও পিছু ছাড়েনি তার।
নরেন্দ্র দামোদর দাসের (মোদি) জন্ম ১৯৫০ সালে গুজরাটের মেহসানা জেলার ভাডনগর গ্রামে। অনগ্রসর ঘাঁচি (তেলি/কলু) সম্প্রদায়ে মুলচাঁন্দ মোদি ও হীরাবেন মোদির ৬ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় তিনি।
মাত্র আট বছর বয়স থেকেই নরেন্দ্র মোদি ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) বিভিন্ন কর্মসূচিতে যাওয়া-আসা করতেন।
এই আরএসএসই হল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মাতৃ সংগঠন। ১৮ বছর বয়সে ওই সংগঠনের খণ্ডকালীন ও ২১ বছর বয়সে পূর্ণকালীন সদস্য মনোনীত হন মোদি।
গুজরাটের হিন্দু ধর্ম অনুসারী ঘাঁচি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী স্কুল জীবন চলাকালেই ১৩ বছর বয়সে যশোদাবেন চিমনলালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মোদি। তবে জীবনের খুব অল্প সময়ই তিনি ছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে এবং এই স্ত্রীর পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন মোদি, যা ভোটের সময় প্রকাশ হয়ে যায়।
১৮ বছর বয়সে মোদি বাড়ি ছাড়েন এবং গুজরাট স্টেট রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন ক্যান্টিনে কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন, পাশাপাশি অংশগ্রহণ করতে থাকেন আরএসএসের বিভিন্ন কার্যক্রমে।
১৯৭০ সালে মোদি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করলে ওই সময়ের আরএসএস সদস্য মোদি আত্মগোপনে চলে যান এবং বিভিন্ন স্থান থেকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করার দায়িত্ব পালন করেন।
এরইমধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন ভারতীয় জন সংঘের ধংসস্তূপ থেকে ১৯৮০ সালে জন্ম নেয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি।
বিজেপিতে যোগ দেয়ার পর দলের কেন্দ্রীয় নেতা মুরলী মনোহর যোশীর সান্নিধ্যে আসেন তিনি। অবশ্য এর আগে ১৯৮৮ সালেই তিনি বিজেপির গুজরাট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
যোশীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুবাদে ১৯৯১ সালে মোদি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৫ তে হন বিজেপি সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
২০০১ সালে গুজরাটের ততকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে প্রথমবারের মত মুখ্যমন্ত্রীর হওয়ার সুযোগ ঘটে মোদির। এক্ষেত্রে বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা এল কে আদবানি তার পক্ষে ছিলেন।
এরপর বিভিন্ন সময়ে আদবানি তাকে রক্ষা করলেও নিজের রাজনীতির পথ পরিষ্কার করতে একসময় আদবানিকেও কৌশলে দলের নীতি নির্ধারণী পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন মোদি।
গুজরাট দাঙ্গা
২০০১ এর অক্টোবরে মোদির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ২০০২ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় গুজরাট দাঙ্গা। ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সহিংস এই দাঙ্গা চলে প্রায় আড়াই মাস পর্যন্ত, যাতে প্রান হারায় প্রায় ১ হাজারেরও অধিক মুসলিম।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিজেপির অটল বিহারি বাজপাই গুজরাটের ঘটনায় মোদিকে দল থেকেই বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সময় আদবানিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতা পক্ষে থাকায় বেঁচে যান মোদি।
এরপর আদবানির সঙ্গে মোদির সম্পর্ক তিক্ত হয় ২০০৫ সালে, যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সেক্যুলার এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন আদবানি।
এই মন্তব্যের কারণে ক্ষোভের মুখে দলের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন আদবানি। তৎকালীন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মোদি এ ক্ষেত্রে আড়াল থেকে ভূমিকা রেখেছিলেন।
আদবানি সরে যাওয়ায় বিজেপিরতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সহজ হয় মোদির জন্য, আর যা তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথও প্রশস্ত করে।