ট্রাম্প তার গত প্রেসিডেন্সির আমলে আমেরিকা সর্বাগ্রে শপথে যেমন একলা চল নীতি নিয়েছিলেন, এবারের নির্বাচনে জিতলে তিনি আরও কঠোরভাবে এই নীতি নিতে পারেন বলে উদ্বেগ আছে।
Published : 03 Nov 2024, 10:06 PM
লৌহমানব সব নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা নিয়ে বড়াই করে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, যেখানে এইসব নেতাদের দূরেই রাখতেন অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্টরা। কিন্তু তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রে আর দুদিন বাদেই অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হলেই তাকে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান আর চীন যে খুশিমনে স্বাগত জানাবে তা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়গুলোর মধ্যে আছে: ইউক্রেইন যুদ্ধ অবসান করা, মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে থাকা সংঘাত মোকাবেলা- যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মূল ভূমিকা আছে; এরপর আছে- উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলা এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য লড়াই সামাল দেওয়া। ট্রাম্প এসব সমস্যা সমাধানের যে দাবি করেছেন তা ভালভাবে করতে পারবেন কিনা প্রশ্ন সোটি।
ট্রাম্প তার গত প্রেসিডেন্সির আমলে আমেরিকা সর্বাগ্রে শপথে যেমন একলা চল নীতি নিয়েছিলেন, এবারের নির্বাচনে জিতলে তিনি আরও কঠোরভাবে এই নীতি নিতে পারেন বলে উদ্বেগ আছে। আর এই শঙ্কার প্রেক্ষাপটেই ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এলে শত্রু কিংবা প্রতিপক্ষ হিসাবে বিবেচিত ওই চার দেশের জন্য তা কী বয়ে আনবে সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে নিউজউইক। ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গেও ম্যাগাজিনটি কথা বলেছে।
চীন:
ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদে চীনের অন্যায় বাণিজ্য মোকাবেলায় দেশটির পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরির অভিযোগে অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এশিয়া এনগেজমেন্ট অ্যান্ড ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ প্রোগ্রামের পরিচালক লিলি গোল্ডস্টেইন নিউজউইককে বলেন, ট্রাম্পের আবার হোয়াইট হাউজে আগমনের আশঙ্কায় চীন উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, ট্রাম্প যদি চীনের সঙ্গে প্রায়োগিক চুক্তি করতে বেশি ইচ্ছুক থাকেন এবং তাইওয়ানকে সরাসরি সমর্থন দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ না করেন তাহলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ইতিবাচক মোড় নেওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা আছে।” তবে লিলির মতে, চীন ট্রাম্পের প্রায়োগিক দিকটিতে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা দেখালেও উত্তেজনা বাড়ানোর পথ থেকে সরে আসবে না-এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কারণ চীন এখন পর্যন্ত কোনও বিষয়েই তাদের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর তেমন লক্ষণ দেখায়নি। সেটি রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মালিকানা দাবি কিংবা তাইওয়ান ঘিরে মহড়া এবং তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করা যা-ই হোক না কেন।
তারপরও গোল্ডস্টেইন মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন এক চীন নীতিকে স্বাগত জানালে চীন এর বিনিময়ে তাইওয়ান প্রাণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরেও উত্তেজনা কমাবে।
ওদিকে, বাকনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ঝিকুন ঝু মনে করেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার প্রেসিডেন্সির আমলে চীনের সঙ্গে সংঘাত চলবেই এমনকি দেশটির সঙ্গে তার বাণিজ্য যুদ্ধ বেড়েও যেতে পারে। আর সেরকম হলে “চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। এতে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা বাড়বে।”
আবার “চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ট্রাম্পের ইগোকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যে প্রতীকী কিছু ছাড় দিতে পারে। যেমন: যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারা আরও কৃষিপণ্য কিনতে পারে। তবে এর বিনিময়ে চীন তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগরে ট্রাম্পের কাছ থেকেও তার অনুকূলে কিছু চাইবেন,” বলেন অধ্যাপক ঝু।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ:
ট্রাম্প বারবারই যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় গেলে ইউক্রেইন যুদ্ধ শেষ করবেন বলে এসেছেন। ইউক্রেইন যুদ্ধ চলার মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসাও করেছেন।
পুতিনকে ‘জিনিয়াস’, ‘স্মার্ট’ বলেছেন ট্রাম্প। অক্টোবরে এসে ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে ইউক্রেইনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার কী হবে সেটি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছেন।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা বিষয়ক অধ্যাপক রবার্ট ওরতুং বলেন, “ইউক্রেইনের চেয়ে রাশিয়াই যে ট্রাম্পের অনেক বেশি পছন্দের তালিকায় আছে- সে ইঙ্গিত মিলেছে তার কথা এবং কাজেই।”
ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দুর্বল, বিভক্ত এবং একনায়কদের হাতে সহজেই ব্যবহার হওয়ার মতো অবস্থায় পড়তে পারে বলেই মনে করেন ওরতুং।
গত সেপ্টেম্বরে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বৈঠকের পর ট্রাম্প তার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক আছে বলেছেন। আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গেও ট্রাম্প তার সম্পর্ক উষ্ণ বলে বর্ণনা করেছেন।
ইউক্রেইনের ঊর্ধ্বতন বিশ্লেষক সায়মন স্কেলেগেল বলেছেন, “ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি ইউক্রেইন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে চান। নির্বাচনে জিতলে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই রাশিয়া এবং ইউক্রেইনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চান। আর এসবকিছুই ইউক্রেইনের জন্য উদ্বেগজনক।
“কারণ, ইউক্রেইন খুব ভাল করেই জানে এ সমস্যা থেকে বেরোনোর কোনও সহজ পথ নেই। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা ইউক্রেইন সরকারের জন্য খুবই বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত হতে পারে, যা নিতে জেলেনস্কি প্রশাসন খুব একটা সিদ্ধহস্ত নয়। কিন্তু ট্রাম্প জিতলে তাদেরকে সেটি করতে হতে পারে।
তাছাড়াও আরেকটি যে বিষয় আছে তা হল “ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। উপরন্তু তিনি পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন অনেকটাই তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ওপর ভিত্তি করে। সেকারণে, ট্রাম্প যদি ইউক্রেইন নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনার চেস্টা করেন আর পুতিন যদি তা না মানেন, তাহলে ট্রাম্প পুরোপুরি ইউক্রেইনকে সমর্থন দিয়ে বসতে পারেন।”
ইরান:
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছিল। দুই বছর পর ইরান ট্রাম্প ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তরি পরোয়ানা জারি করে। ইরাকে ইরানের কাসেম শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলেমানিকে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলায় হত্যা করার কারণে ওই পদক্ষেপ নিয়েছিল তেহরান।
আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক জার্মান ইন্সটিটিউটের ফেলো গবেষক হামিরেজা আজিজি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে কঅ ঘটবে সে ব্যাপারে ইরানে সবার মত এক নয়। তবে তেহরানের অভিজাত রাজনৈতিক মহলে বেশিরভাগেরই মত হচ্ছে- “আগামীতে ইরানের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপই হতে চলেছে।
“আর তা হবে ট্রাম্পের ইরানের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টির ইতিহাস, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের সখ্যতা, ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন এবং ট্রাম্পের হুটহাট কোনও কিছু করে বসার অভ্যাসের কারণে”, বলেন আজিজি।
তিনি বলেন, “ইরানে আরেকটি দল মনে করে, ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলে আসা ঘোর শত্রুতা থাকবে- তা হোয়াইট হাউজে যিনিই আসুন না কেন। তবে ইরানের কিছু মানুষ আশা করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি ইরানের জন্য ভাল কিছুই বয়ে আনবে। কারণ, তিনি ব্যবসায় অনেক বেশি উন্মুক্তমনা। ট্রাম্পের সঙ্গে কোনও চুক্তি করতে চাইলে সেটি করা হ্যারিসের তুলনায় অনেক বেশি সহজ হবে।”
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যেমন থাকবে তার পরিণতি অনুভূত হবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, বিশেষ করে এ অঞ্চলে লেবানন, ইসরায়েল, ইরান এমনকী ইয়েমেনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সংঘাত উত্তেজনার এই সময়ে এ সম্পর্কের বিষয়টি আরও গুরুত্ববহ।
ট্রাম্প এখন পর্যন্ত যে সংকেত দিয়েছেন, তাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন এবং ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা নেওয়ার মাঝেই ইরানের সঙ্গে সংঘাতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বসতে পারেন। আজিজি বলেন, “সেক্ষেত্রে তার আশঙ্কা- চলতি নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে হয়ত ইরান এবং ইসরায়েলকে প্রকৃতই যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে দেখতে পাবে বিশ্ব।”
উত্তর কোরিয়া:
উত্তর কোরিয়ায় প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে পা রেখেছিলেন ডনা্ল্ড ট্রাম্প। তখন দেশটির নেতা কিমের সঙ্গে ভাল সম্পর্কেরই বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরপরও কিম এবং ট্রাম্প পরস্পরের প্রতি তীব্র বিদ্রুপের তীর ছুড়েছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প 'লিটল রকেট ম্যান' নাম দিয়েছিলেন কিম জং-উনকে। জাতিসংঘে এক ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করে দেবেন।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সেই প্রথম বৈঠকের পর পারমাণবিক কর্মসূচি হ্রাসের পদক্ষেপ দেখালেও পরে তা থেকে সরে এসেছেন। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের ৫ দিন আগেও দেশটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক শিকাগো কাউন্সিলে এশিয়া স্টাডিজ এর ফেলো কার্ল ফ্রাইডহফ বলেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে আন্তসংস্থা সমন্বয় (কয়েকটি সংস্থা মিলে সমস্যা সমাধানে কাজ করা) তেমন থাকবে না, যেখান থেকে উত্তর কোরিয়ার কোনও কার্যোদ্ধার হতে পারে। বরং বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতিই দেখা যেতে পারে বলে মনে করেন ফ্রাইডহফ।
তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প যখন কিমের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তখন পিয়ংইয়ং কোনও চুক্তি করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু এবার ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলে পরিস্থিতি সেরকম হবে না।
উত্তর কোরিয়া এবার আলোচনা করতে আগের চেয়ে বেশি ভালভাবে প্রস্তুত থাকবে এবং ট্রাম্পের দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজবে। তাদের সেই আলোচনা তখন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি এবং কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলের জন্য প্রকৃতই ‘তুরুপের তাস’ হয়ে উঠবে।