দুই প্রার্থী হ্যারিস আর ট্রাম্পের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত ‘হ য ব র ল’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বা তার চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
Published : 05 Nov 2024, 01:34 AM
ভোট দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা; জিতবেন একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, নয়ত বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভোটের ফল যাই হোক, তার সুদুরপ্রসারী প্রভাব থাকবে বিশ্বজুড়ে।
রাজনীতির ক্যারিয়ারে খাদের কিনার থেকে উঠে আসা সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যদি মঙ্গলবারের ভোটে জিতে যান, তাহলে সেটা হবে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রে পরাজিত প্রেসিডেন্টের ফের নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড আছে কেবল গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের। ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হেরে গিয়ে চার বছর পর ফের তিনি জয়ী হয়েছিলেন ১৮৯২ সালে।
ট্রাম্প এবার জিতলে তিনি হবেন এদিক থেকে দ্বিতীয়। আর ভোটারদের রায় যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পক্ষে যায়, তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এবারের নির্বাচনের মত বিভক্তি অতীতে কমই দেখা গেছে । ভোটারদের মধ্যে প্রধান দুই প্রার্থীর জনসমর্থন নারী ও পুরুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। নারীদের মধ্যে বেশি সমর্থন কুড়িয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস। আর পুরুষদের মধ্যে রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্প।
আবার হিসপ্যানিক ও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের দীর্ঘদিনের সমর্থনলাভের ধারাও এবার বদলে যেতে দেখা গেছে। যে হিসপ্যানিকদের সমর্থন ডেমোক্র্যাটরা সবসময়ই বেশি পেয়ে এসেছে, এবার তা বিশেষতঃ পুরুষদের মধ্যে ঘুরে গেছে ট্রাম্পের দিকে। আবার যে শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন রিপাবলিকানরা বেশি পেয়ে এসেছে, এবার তা নারীদের মধ্যে ঘুরে গেছে হ্যারিসের দিকে।
বিভিন্ন জনমত জরিপ, এমনকি জয়-পরাজয় নির্ধারণী দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর জরিপেও জনসমর্থনের দিক থেকে দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান খুবই কম। অধিকাংশ জনমত জরিপেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
মাত্রার দিক থেকে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আগের দুই নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভোটের ফল পক্ষে না গেলে ট্রাম্প যদি গতবারের মত বেঁকে বসেন, তাতে শেষ পর্যন্ত ‘হ য ব র ল’ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কাও বাদ দিতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো এবং সহিংসতার হুমকি থাকার পরও মঙ্গলবার নিরাপদেই ভোটগ্রহণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তারপরও অভাবনীয় কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা তো সব সময় থেকেই যায়।
হাতি বনাম গাধা
ঐতিহ্যগতভাবে নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবারই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। নির্বাচনে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে নামলেও শেষ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা হয় মূলত দুই বড় দলের দুই প্রার্থীর মধ্যে। সেটা রিপাবলিকানদের 'হাতি' ও ডেমোক্র্যাটদের 'গাধা'র লড়াই।
ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান পার্টির ডনাল্ড ট্রাম্প সোমবার শেষ মুহূর্তের প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অর্থনীতি থেকে শুরু করে অভিবাসন কিংবা পররাষ্ট্র- প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের নীতি বা দৃষ্টিভঙ্গির দিকে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, বহির্বিশ্বও চোখ রাখছে।
এবারের নির্বাচনি প্রচারে হ্যারিস এবং ট্রাম্প বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অবস্থানের নিরীখে ভোটারদের সমর্থন কুড়িয়েছেন। মূল্যস্ফীতি, কর, গর্ভপাত, অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্য ইস্যুতে দুই প্রার্থী ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেছেন।
কমলা হ্যারিস বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে প্রথম দিন থেকেই তার অগ্রাধিকার হবে শ্রমজীবী পরিবারের জন্য খাবার ও বাসস্থান খরচ কমানো। নিত্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দাম নির্ধারণের প্রবণতা বন্ধ করা এবং প্রথমবার বাড়ি কেনায় সহায়তা ও আবাসন খাতে প্রণোদনা দেয়ার কথাও বলেন তিনি।
ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছেন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সবকিছু মানুষের ক্রয় সামর্থ্যের মধ্যে আনার। অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠালে আবাসনের ওপর চাপ কমবে বলে মনে করেন তিনি। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপেরও আভাস দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
অন্যদিকে, করের ক্ষেত্রে- বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং বছরে চার লাখ ডলারের বেশি আয় করা আমেরিকানদের ওপর কর বাড়াতে চান হ্যারিস। যদিও কোনো কোনো পরিবারের করের বোঝা লাঘব করতে, সন্তানের বিপরীতে কর ছাড়ের ব্যবস্থা রাখার কথাও বলেছেন তিনি।
ট্রাম্পও বিপুল পরিমাণ করছাড় দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন। তবে সেটি তার ২০১৭ সালের কর কমানোর নীতিরই আরেক রূপ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধনীদের জন্যই সহায়ক ছিল।
হ্যারিস গর্ভপাতের অধিকারকে তার প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছিলেন। সারাদেশের নারীদের জন্য প্রজনন অধিকার সুরক্ষা আইনের পক্ষে তিনি কথা বলছেন।
ট্রাম্প গর্ভপাত বিষয়ে বলেছেন, নারীদেরকে যাতে গর্ভপাতের কথা ভাবতে না হয় সেটি তিনি নিশ্চিত করবেন। তবে সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পের সময়ে নিয়োগ দেওয়া তিন বিচারকের হাতেই যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল হয়েছিল। সে কারণে গর্ভপাত ইস্যুতে নারীদের মন জয় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে ট্রাম্পকে।
অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্প সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কাজ শেষ করতে চান। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে আরও বেশি করে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য মোতায়েনের অঙ্গীকার করছেন তিনি। অবৈধ অধিবাসীদের গণহারে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কথাও ট্রাম্প বলেছেন।
তবে হ্যারিস কঠোর অভিবাসন নীতি নেওয়া কোনো সর্বদলীয় আইন প্রণয়নে অংশ না নিতে রিপাবলিকানদের আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচিত হলে তিনি এ বিষয়ে সমঝোতার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।
ভোটারদের মধ্যে দুই প্রার্থীর জনসমর্থনের দিক দিয়ে শেষ সময়ের জরিপগুলোতে দেখা গেছে, অর্থনীতি, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের প্রশ্নে ট্রাম্প সমর্থন বেশি পাচ্ছেন। আবার হ্যারিস সমর্থন বেশি পাচ্ছেন রাজনৈতিক উগ্রবাদ এবং গণতন্ত্রে হুমকি মোকাবেলার প্রশ্নে।
জুলাইয়ের শেষের দিকে নির্বাচনী দৌড়ে নামার পর থেকে হ্যারিস জাতীয় জরিপের গড় অনুযায়ী ট্রাম্পের চেয়ে সামান্য এগিয়ে ছিলেন। কমলা হ্যারিসের প্রচারের প্রথম কয়েক সপ্তাহে হুট করেই তার জনসর্থন বেড়ে যায়। আগস্টের শেষের দিকে প্রায় ৪ শতাংশ পয়েন্ট বেশি জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি।
১০ সেপ্টেম্বর দুই প্রার্থীর মধ্যে অনুষ্ঠিত বিতর্কের পরেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিপের ব্যবধান তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। তবে এরপরের জরিপের ফলগুলোতে দিন দিনই তাদের মধ্যে ব্যবধান কমে লড়াই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ার আভাস মিলেছে।
ব্যবধান এক সুতো
রয়টার্স/ইপসোস পরিচালিত সর্বশেষ গত মঙ্গলবারের জরিপে দেখা গেছে, দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান ১ শতাংশ পয়েন্টে এসে ঠেকেছে। হ্যারিস পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ সমর্থন আর ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৩ শতাংশ সমর্থন। অর্থাৎ, দুই প্রার্থীর অবস্থান প্রায় সমান সমান।
এর আগে ২৫ অক্টোবরের নিউ ইয়র্ক টাইমস/সিয়েনা কলেজ জাতীয় জরিপে হ্যারিস এবং ট্রাম্পের জনসমর্থন সমান দেখা গিয়েছিল। দুজনই ৪৮ শতাংশ ভোটার সমর্থন পেয়েছিলেন।
গত জুনে ট্রাম্পের বিপক্ষে প্রার্থী ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২৭ জুন ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম টিভি বিতর্কে বাইডেন খারাপ ফল করেন। এতে নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের তুলনায় জনসমর্থনে ট্রাম্পকে ৪ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে।
এরপরই বাইডেন নির্বাচনি দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে তার জায়গায় কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেন। আর তাতেই ঘুরে যায় দৃশ্যপট। নবশক্তি আর নবোদ্যমের সঞ্চারে ট্রাম্প ও হ্যারিসের জনসমর্থন সমানে সমান হওয়া থেকে শুরু করে পরে ট্রাম্পের চেয়ে একটু এগিয়েই যান হ্যারিস।
নির্বাচনি দৌড়ে হ্যারিসকে তরতর করে সামনে এগিয়ে দেওয়ার চাবুক হিসাবে কাজ করেছে স্যোশাল ইনফ্লুয়েন্সার বাহিনী। হ্যারিস ধীরে ধীরে ইন্টারনেটে রকস্টারের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারায় তার অনুকূলেই স্যোশাল মিডিয়ায় মানুষ মত দিয়েছে বেশি। নামিদামি তারকা থেকে শুরু করে তরুণদের সমর্থনও তিনি টানতে পেরেছেন এভাবে।
সামগ্রিকভাবে সারা দেশে কোনো প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কতটা সেটি জাতীয় জরিপগুলো লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। যদিও এসব জরিপ জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হলেও নির্বাচনের ফলের পূর্বাভাস দেওয়ার সঠিক উপায় নয়।
কীভাবে নির্বাচিত হন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট?
যুক্তরাষ্ট্রে যে পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, তাকে বলে ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেম।
ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন, তাদের বলা হয় ইলেকটর।
এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে বলা হয় ইলেকটোরাল কলেজ । ৫০টি রাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি।
এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীর কথা মাথায় রেখে ভোট দিলেও এলে তারা আসলে ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে এই ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউজের চাবি।
যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি রাজ্য রয়েছে তবে তাদের বেশিরভাগই প্রায় সব সময় একই দলকে ভোট দেয়। বাস্তবে কেবল কয়েকটি মুষ্টিমেয় রাজ্য আছে যেখানে উভয় প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এই রাজ্যগুলো ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বা দোদ্যুল্যমান রাজ্য হিসাবে পরিচিত।
দোদ্যুল্যমান রাজ্যগুলো
এবারের নির্বাচনে জাতীয় জরিপে তো বটেই, দোদুল্যমান হিসাবে বিবেচিত সাতটি রাজ্যেও দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে।
বাইডেন প্রার্থী থাকা পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক দলের জনপ্রিয়তা খুব বেশি চোখে পড়ার মত ছিল না, তবে হ্যারিস তার জায়গায় প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই নির্বাচনী জরিপের ফলে বেশ পরিবর্তন আসে। কিছু রাজ্যে ট্রাম্প একচেটিয়া জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন, তবে হ্যারিস যোগ দেওয়ার পর সেসব জায়গায় জনসমর্থন ভাগাভাগি হয়েছে।
যেমন, যেদিন বাইডেন দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান, সেদিন তিনি সাতটি সুইং রাজ্যে গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ পয়েন্টে ট্রাম্পের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু পরে দোদ্যুল্যমান রাজ্যের গড় জরিপ অনুযায়ী, হ্যারিস এবং ট্রাম্পের মাঝে ব্যবধান খুবই সামান্য দেখা গেছে।
অক্টোবরের শেষ দিকের জরিপগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, সাতটি দোদ্যুল্যমান রাজ্যে কমলা হ্যারিস এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের একে অপরের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গেছে। আর জরিপে ব্যবধান যখন অনেক কম হয়, তখন বিজয়ী কে হবেন সে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
জরিপে ট্রাম্প এবং হ্যারিসের মধ্যে ব্যবধান যেমন কম দেখা যাচ্ছে, ভোট গণনার পরও যদি দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান ততটাই কম থাকে, তাহলে নির্বাচনে কে জয়ী হচ্ছেন তা স্পষ্ট হতে কোনো কোনো রাজ্যে অনেক বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
আবার আগাম ভোট গণনা এবং পোস্টাল ব্যালট পাওয়া ও গণনায় একেক রাজ্যের একেক নিয়মের কারণে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। ফলে ভোটের ফল প্রকাশে গতবারের মত দেরি হতে পারে। আর এই দেরির সুযোগে নিজের জয় ঘোষণা করে ট্রাম্পের ঝামেলা পাকানোর শঙ্কা থাকছে, যেমনটি তিনি করেছিলেন ২০২০ সালের নির্বাচনে। সেরকম কিছু হলে পরিস্থিতি গড়াতে পারে বিশৃঙ্খলার দিকে।
দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান খুবই সামান্য হলে অল্পসংখ্যক ব্যালট নিয়ে বিতর্ক তখন আদালতের লড়াইয়েও গড়াতে পারে।
উদ্বেগ আরো আছে
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ওয়াশিংটন এবং ওরেগন রাজ্যে দুটি ব্যালট ড্রপ বাক্সে আগুন দেওয়ার ঘটনায় শত শত ব্যালট নষ্ট হয়েছিল। ওরেগনের পোর্টল্যান্ডে একটি ব্যালট ড্রপ বাক্স এবং ওয়াশিংটনের ভ্যাংকুভারের কাছে আরেকটি ড্রপ বাক্সে দাহ্যবস্তু বা অগ্নিসংযোগের যন্ত্র বসানো ছিল।
এর আগে গত ৮ অক্টোবরে ওয়াশিংটনের ভ্যাংকুভারে আরেকটি আলাদা ব্যালট ড্রপবাক্সে আগুন লাগার ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া গিয়েছিল। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে অ্যারিজোনাতেও।
নির্বাচন কর্মীরা এবছর হুমকি-ধামকিও পেয়েছে। উইসকনসিন রাজ্যে প্রায় চারজনে একজন (৩৮ শতাংশ) স্থানীয় নির্বাচনি কর্মকর্তার ভোটের কাজ করতে গিয়ে হুমকি পাওয়া, হয়রানি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে- এমনটিই দেখা গেছে ব্রেনান সেন্টার ফর জাস্টিস পরিচালিত জরিপের ফলে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের নির্বাচনের পর থেকেই ভোটগ্রহণের কাজ অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সেই সময় থেকে নির্বাচনি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হুমকি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ভোট জালিয়াতির ভিত্তিহীন অভিযোগ শুনে যারা তৎপর হয়ে ওঠে, তাদের দিক থেকে এই হুমকি বেড়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার মধ্য যে বিষয়টি উদ্বেগ বাড়িয়েছে, তা হল নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে সাদা পাউডার ভর্তি চিঠি আসার খবর। ১৫টি রাজ্যে এমন চিঠি আসার খবর মিলেছে।নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে অনেক সময় ভুয়া ৯১১ কলও আসে।নির্বাচন কর্মীদের ক্ষেত্রে এমন ভুয়া কল বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়।
এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কর্মকর্তাদেরকে এবার ভোটের দিনে কর্মী ও ভোটারদের সব ভোটকেন্দ্রে নিরাপদ রাখতে নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।
এবারের নির্বাচনি প্রচারেও ছিল বিভ্রান্তিকর তথ্যের ছড়াছড়ি। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়েছে, গুজব, বিভ্রান্তিকর অভিযোগ এবং ভোট জালিয়াতির মিথ্যা তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে বিপুল মাত্রায়।
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনলাইনের পোস্টগুলোতে রিপাবালিকান প্রার্থী ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের মিথ্যা দাবিকে সমর্থন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছিলেন। এবার ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে তাকে আবারও ‘প্রতারণা করে পরাজিত করা’ হতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতরা বলছেন, এ ধরনের সংকেতই আরও বেশি করে বলে দিচ্ছে যে, ২০২৪ সালের এই নির্বাচন নিয়ে আগে থেকে কিছুই বলা যাবে না এবং এতে বিঘ্ন ঘটারও ঝুঁকি আছে। দফায় দফায় বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে পণ্ডিতরা সবাই এ ব্যাপারেও একমত পোষণ করেছেন যে, আগামী দিনগুলোতে গণতন্ত্র কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে পারে।
বার্কলের রাজনীতি বিজ্ঞানী এরিক শিকলার বলেন, “প্রার্থী যখন ট্রাম্প, আর তিনি যখন অনবরতই বলে আসছেন যে ২০২০ সালের নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তখন এবারের নির্বাচনে তিনি হারলে ভোটের ফলকে চ্যালেঞ্জ করবেন- এমনটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।
“তাছাড়া, ভোটের ফল যদি খুব কাছাকাছি হয়, তাহলে আবার সেটি উল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলবে তেমনটি বিশ্বাস করারও অনেক কারণ আছে। সেই চেষ্টা যে বিফল হবে তা হলফ করে বলা যাবে না। আর বিফল যদি হয়ও, তাহলেও সেটি নিশ্চিতভাবেই এক হ য ব র ল প্রক্রিয়া হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রে এক দশক আগেও গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে এমন গুরুতর উদ্বেগের কথা কেউ কল্পনা করতে পারত না।
নির্বাচনি আইন বিশেষজ্ঞ ও বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এমিলি রং-ঝ্যাং বলেন, “সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিরাপদে হয় এবং ভোটও সঠিক ও নির্ভরযোগ্যভাবে গণনা হয়। অনেক ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে এবং নির্বাচন স্বচ্ছও হয়।”
‘গোল্ডম্যান স্কুল অব পাবলিক পলিসি’র নতুন ডেমোক্রেসি পলিসি ল্যাবের প্রধান জ্যাকব গ্রামব্যাচও মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরীক্ষার মুখে পড়লেও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে তেমন সম্ভাবনাই বেশি। সেদিক থেকে সত্যিকারের কোনো অভ্যুত্থান ঘটে যাওয়া বা নির্বাচনি বিপর্যয় ঘটার ঝুঁকি ১ শতাংশেরও কম।”
কিন্তু আরেক ধরনের বিদ্রোহ, সেটি হতে পারে সহিংস- যেমনটি দেখা গিয়েছিল ক্যাপিটল হিলে- ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে- সেই ধারায় এবারও কিছু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি গ্রামব্যাচ।
যুব ভোটে কড়াকড়ি
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীতে গিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই জেনারেশন জেড এবং তরুণ ভোটারদের কোণঠাসা করে রাখার কৌশল কাজে লাগানোর ইচ্ছার প্রকাশ রিপাবলিকানরা ইতোমধ্যে ঘটিয়েছে। এবছরও এই কৌশল কাজে লাগানো চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত আইনসভা হাই স্কুল এবং কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে নতুন নতুন বাধার দেয়াল তুলছে। রাজ্য আইনপ্রণেতাদের বক্তব্য, তারা একাজ করছে ভোটার জালিয়াতি ঠেকানোর জন্য। তবে সমালোচকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে তারা যুব ভোট দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কারণ, তরুণ ভোটাররা দলে দলে ডেমোক্র্যাটদের হাত শক্তিশালী করছে।
তরুণ ভোটারদের ভোট বাড়তে থাকায় তাদের ভোট দেওয়ার ওপর কড়াকড়ি করে বিভিন্ন রাজ্যে নতুন নতুন আইন পাস হচ্ছে। কঠোর করা হচ্ছে তাদের ভোটার আইডির নিয়মকানুন। ভোট দেওয়ার ওপরও আরোপ হচ্ছে নানা বিধিনিষেধ।
বিশেষজ্ঞ জশুয়া ক্লার্ক মনে করেন, এভাবে ভোট দমন এখনও লক্ষ্যণীয় বিষয় হয়ে আছে। প্রায়ই এর নিশানা হয় তরুণরা, সেইসব শিক্ষার্থীরা, যারা বাড়ি থেকে দূরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
তার মতে, কিছু কিছু রাজ্যে তরুণদের ভোট দেওয়ার নতুন ওই সব কড়া নিয়মকানুন এবছরের ভোটে প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে প্রথম যারা ভোট দেবে বা যারা তরুণ ভোটার তাদের ওপর।”
আবার ভয়ভীতি দেখিয়েও যে তরুণদেরকে ভোট দিতে যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চলছে- সে উদাহরণও দিয়েছেন ক্লার্ক। তিনি জানান, উইসকনসিনে শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি উড়ো টেক্সট মেসেজ পেয়েছে। তাতে ভয় দেখিয়ে সবধান করে দিয়ে লেখা হয়েছে যে, তারা ঠিকমত ভোট না দিলে তাদের বিচার করা হতে পারে।
সেই ৬ জানুয়ারির পর বদলেছে সবই
চার বছর আগে ট্রাম্প ভোট চুরি বন্ধের যে প্রচার চালিয়েছিলেন, তা রিপাবলিকানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস জন্মে দিয়েছিল যে, বাইডেন ভোটে কারচুপি করেছেন। আর ট্রাম্পের সেই প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সমর্করা কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা বাধিয়ে বসেছিল।
যদিও সেবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার অনেক প্রমাণই ছিল। তারপরও সন্দেহ থেকেই গেছে। এবছর ট্রাম্প বারবারই যুক্তি দিচ্ছেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি হারতে পারেন না। আর তা না হলে তিনি নতি স্বীকার করবেন না।
‘বার্কলে ইন্সটিটিউট অব গভমেন্টাল স্টাডিজ’ এর বিশেষজ্ঞ শিকলার বলেন, “২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটলে সেই দাঙ্গার পর সবই বদলে গেছে। এখন ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটকে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায়- এটি হচ্ছে ৬ জানুয়ারি পরবর্তী নির্বাচন।”
শিকলারের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞ গ্রামব্যাচও। তিনি বলেন, ব্যাপক ভোটার জালিয়াতি, ভোট চুরির ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এসবের কোনো ভিত্তি বাস্তবে নেই। ট্রাম্প এসব নিয়ে ‘বাড়িয়ে বলছেন’। চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প নিজেই দোদুল্যমান রাজ্য পেনসিলভেইনিয়ায় ব্যাপক ভোটার জালিয়াতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
ট্রাম্পের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রিপাবলিকানরাও এসব নিয়ে উদ্বেগ উসকে দিচ্ছে। কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের ‘গণ ভোট জালিয়াতির’ কথা তারা বলছে। তাতে নির্বাচনে মানুষের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, বিদ্রোহের ঝুঁকি বাড়ছে।
নির্বাচিত কর্মকর্তারা আরেকটি ৬ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে রাজ্য এবং জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংস্কার এবং কড়াকড়ির পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু ফল হয়েছে মিশ্র।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২০ সাল থেকে ভোটিং সিস্টেমে আস্থা নষ্ট করা এবং সন্দেহ সৃষ্টির এত চেষ্টা চলেছে যে, ভোটাররা ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন। তারা বুঝতে পারছে না কাকে বিশ্বাস করবেন আর কাকে করবেন না।