ইরানের লাখ লাখ মানুষের সামাজিক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নানা ধরনের প্রত্যাশার কেন্দ্রে আছেন পেজেশকিয়ান।
Published : 06 Jul 2024, 08:26 PM
মধ্যপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান স্বল্প পরিচিত একজন আইনপ্রণেতা ও কার্ডিয়াক সার্জন থেকে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
ইরানের লাখ লাখ মানুষের সামাজিক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নানা ধরনের প্রত্যাশার কেন্দ্রে আছেন পেজেশকিয়ান (৬৯) ।
শুক্রবার ইরানের দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টর রক্ষণশীল সাইদ জালিলিকে হারিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত পেজেশকিয়ান। তিনি ইরানের ১৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটির নবম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।
তার জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের মাহাবাদ শহরে, জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা ইরনা।
হাই স্কুল শেষে প্রথম ডিপ্লোমা অর্জনের পর পেজেশকিয়ান সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। তার পোস্টিং হয় ইরানের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় শহর জাবোলে। এখানে থাকাকালেই তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানে দ্বিতীয় ডিপ্লোমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৬ সালে তাব্রিজ মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
পেজেশকিয়ান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং জেনারেল সার্জারির বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। ১৯৮০-র দশকে ইরান–ইরাক যুদ্ধে অংশ নেন ও চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসাকর্মীদের মোতায়েনের দায়িত্ব ছিল তাঁর।
১৯৯৩ সালে তিনি ইরান মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কার্ডিয়াক সার্জারির বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি পান। পরে তিনি হার্ট সার্জারির বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তিনি পাঁচ বছর তাব্রিজ মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
১৯৯৪ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও এক সন্তান হারান। পরে আর বিয়ে করেননি। দুই ছেলে ও অপর এক মেয়েকে নিয়েই থাকেন তিনি। ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অষ্টম পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমবারের মতো আইন পরিষদ মজলিশের সদস্য হন। এরপর থেকে আইনপ্রণেতা হিসেবে বিভিন্ন পার্লামেন্টে ছিলেন তিনি। তিনি সংখ্যালঘু আজেরি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার।
দশম পার্লামেন্টে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। চলতি বছরের প্রথম দিকে সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তিনি মজলিশের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন পূর্ব আজারবাইজানের প্রাদেশিক রাজধানী তাব্রিজ থেকে।
এর আগে দুইবার তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমবার ২০১৩ সালে ইরানের সাংবিধানিক কাউন্সিলের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে প্রয়াত আলি আকবার হাশেমি রাফসানজানির পক্ষে নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন।
দ্বিতীয়বার ২০২১ সালে আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেবার সাংবিধানিক কাউন্সিল তাকে মনোনয়ন দেয়নি।
চলতি বছর মাসুদ পেজেশকিয়ান ‘ন্যায়বিচার’ নামের একটি প্লাটফর্ম থেকে ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান। তাদের শ্লোগান ছিল ‘ইরানের জন্য ঐক্য ও সংহতি’।
বিশ্লেষকদের ধারণা পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়েনে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করবেন পেজেশকিয়ান।
রয়টার্স জানিয়েছে, পেজেশকিয়ান এমন একটি নির্বাচনী এলাকা নিয়ে জিততে সক্ষম হয়েছেন - যারা মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ জনগোষ্ঠী বলে ধারণা করা হয়।
তিনি ইরানকে বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করতে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে স্থগিত আলোচনায় উত্তেজনা প্রশমন এবং সামাজিক উদারীকরণ ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদের সম্ভাবনা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে ইরানের ধর্মীয় ও প্রজাতান্ত্রিক শাসনের দ্বৈত ব্যবস্থার অধীনে, পারমাণবিক কর্মসূচি বা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করার বিষয়ে কোনও বড় নীতিগত পরিবর্তন আনার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নেই। কারণ দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এগুলোকে শীর্ষ রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
তবে নবনির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট ইরানের বিভিন্ন নীতির সুরকে প্রভাবিত করতে পারেন। বর্তমানে ৮৫ বছর বয়সী খামেনির উত্তরসূরি বাছাইয়েও্ তিনি বিশেষ প্রভাব রাখতে পারবেন।
পেজেশকিয়ান ইরানের ধর্মতান্ত্রিক শাসনের প্রতি আস্থাশীল। শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী এবং ধর্মীয় শাসকদের মুখোমুখি হওয়ার কোনও ইচ্ছা তার নেই।
রয়টার্স জানায়, সাক্ষাৎকারে তিনি খামেনির নীতির বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ভোটারদের উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় পেজেশকিয়ান বলেন, “আমি যদি আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টা করি কিন্তু ব্যর্থ হই, তবে আমি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিদায় জানাব।”
গত মে মাসে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হন। এ ঘটনার পর আয়োজিত আগাম নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির নেতৃত্বাধীন সংস্কারপন্থী শিবির পেজেশকিয়ানকে সমর্থন দেয়। বছরের পর বছর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার পর নীরব সংস্কারবাদী নেতারা সরব হয়ে উঠেন।
ইরানের চূড়ান্ত ক্ষমতা সর্বোচ্চ নেতা খামেনির হাতে, তাই সংস্কারবাদী পেজেশকিয়ান প্রেসিডেন্ট হলেও দেশটির নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু দেশটির প্রেসিডেন্ট সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন এবং দেশটির বৈদেশিক নীতির সুরকে প্রভাবিত করতে পারেন।
"পেজেশকিয়ান কিছু সামাজিক স্বাধীনতা আনতে সক্ষম হতে পারেন। তবে তিনি দুর্বল প্রেসিডেন্ট হবেন কারণ খামেনি ও তার মিত্ররা প্রেসিডেন্টের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী," বলেছেন ইরানের কিশ দ্বীপের ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেইনি (৪৫) ।