তাইওয়ান ঘিরে চীনের সামরিক মহড়ায় বাড়ছে সংঘাতের ঝুঁকি

মার্কিন স্পিকার পেলোসির সফরের বিরুদ্ধে চীন তাদের প্রতিবাদী মহড়া থেকে পুরোদস্তুর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া এড়াতে চাইলেও পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠার ঘোর ঝুঁকি আছে, বলছেন বিশ্লেষকরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2022, 03:42 PM
Updated : 3 August 2022, 04:04 PM

ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাতে তাইওয়ান ঘিরে আকাশ ও সমুদ্রে ছয় দিনের যে নজিরবিহীন সামরিক মহড়া চালাতে শুরু করেছে চীন, তা যে কোনও সময় সংঘাতে রূপ নেওয়ার ঝুঁকি প্রবল বলে সতর্ক করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

চীন এমনকী পেলোসির সফরের বিরুদ্ধে তাদের এই প্রতিবাদী মহড়া থেকে পুরোদস্তুর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া এড়াতে চাইলেও পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠার ঘোর ঝুঁকি আছে- বলছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পেলোসি সদ্যই তাইওয়ান সফর শেষ করেছেন। মঙ্গলবার রাতে তিনি তাইওয়ান যান। তার এশিয়া সফরসূচিতে আগে থেকে তাইওয়ানে যাওয়ার বিষয়টির উল্লেখ না থাকলেও তিনি সেখানে যেতে পারেন বলে আগেই ধারণা করা হয়েছিল।

যা নিয়ে ক্রমাগত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছিল চীন। স্বশাসিত তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও চীন তা একেবারেই মানে না। বরং তারা তাইওয়ানকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশ মনে করে, যারা একদিন পুনরায় এক হবে।

চীন সরকারের কাছে তাইওয়ান ইস্যু অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাইওয়ানের বেলায় তারা ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে। চীনের বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টিও তাদের ‘এক চীন নীতির’ উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থায় তিন নম্বরে থাকা পেলোসির তাইওয়ান সফরকে চীন তাদের অভ্যন্তরীন বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং সর্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি বলে বিবেচনা করেছে এবং বলেছে, এর বিরুদ্ধে তারা কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

চীন সেটাই করছে। পেলোসি যে রাতে তাইওয়ানে পা রাখেন সেই রাতেই চীন তাইওয়ানের চারপাশে ছয়টি জায়গায় সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণা দেয়। চীন সরাসরি গোলাগুলির মহড়াও (লাইভ ফায়ার ড্রিল) করবে। যাকে জাতিসংঘের কনভেনশনের লঙ্ঘন বলছে তাইওয়ান।

চীন যে ছয়টি ‍অঞ্চলে সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণা দিয়েছে তার তিনটিই তাইওয়ানের ১২ নটিক্যাল মাইল সীমানার মধ্যে পড়েছে।

চীনের ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বুধবার তাদের নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, রকেট ফোর্স, স্ট্রাটেজিক সাপোর্ট বাহিনী এবং জয়েন্ট লজিস্টিক সাপোর্ট ফোর্স তাইওয়ানের উত্তর, দক্ষিণপশ্চিম এবং দক্ষিণপূর্বে আকাশ ও সমুদ্রে মহড়ায় অংশ নিয়েছে।

মহড়ায় চীনের সেনাবাহিনী অবরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন ছাড়াও সমুদ্র ও ভূমি থেকে আক্রমণ চালানোর অনুশীলন করবে বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

এ বিষয়ে কয়েকজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তারা বলেন, চীন সরাসরি তাইওয়ানের উপর দিয়ে ক্রুজ বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়বে কিনা কিংবা প্রথমবারের মত দ্বীপটি অবরোধের চেষ্টা করবে কিনা সেটি এখনও স্পষ্ট নয়।

হংকং ভিত্তিক সামরিক বিশেষজ্ঞ সং ঝংপিং বলেন, ‘‘দেখে যা মনে হচ্ছে, পরবর্তীতে যদি চীনকে যুদ্ধে জড়াতে হয়, তাই এখনই তাদের পিপলস লিবারেশন আর্মি দ্বীপটি অবরোধ করার অনুশীলন করতে চাইছে।”

‘‘স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এ মহড়ার লক্ষ্য চীনের সেনাবাহিনীকে তাইওয়ানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত করা।”

চীন এবার ‍তাদের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াতে কোথায় কোথায় মহড়া চলবে তা উল্লেখ করে একটি ম্যাপ প্রকাশ করেছে, যা খুবই অস্বাভাবিক। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, চীন সরকার দেশি এবং বিদেশি উভয় দর্শককে এর মাধ্যমে তাদের মহড়ার গুরুত্ব বোঝাতে চাইছে।

চীন যা করতে চাইছে যদি তারা তা করতে সক্ষম হয়, তবে পুরো অঞ্চলে এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করেছেন তাইওয়ানের নিরাপত্তা পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘‘এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে, একইসঙ্গে এ অঞ্চলের অর্থনীতির উপরও।”

সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কলিন কোহ বলেন, পেলোসির তাইওয়ান সফর চীনকে একইসঙ্গে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে অবিচল থাকা এবং নিজেদের সামরিক শক্তি ও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখানোর ফাঁদে ফেলে দিয়েছে।

‘‘এমনকী যদি চীন পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ এড়িয়েও যেতে চায়, তারপরও দুর্ঘটনাক্রমে সেখানে আরও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির ঘোর আশঙ্কা আছে,” বলেন তিনি।

এর আগে ১৯৯৬ সালে তাইওয়ানে প্রথমবার সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল বেইজিং। যেটি ‘থার্ড তাইওয়ান স্ট্রেইটস ক্রাইসিস’ নামে পরিচিত। কিন্তু সেবার চীন তাইওয়ানের জলসীমার এতটা ভেতরে প্রবেশ করেনি, যতটা এবার তারা মহড়ার ম্যাপে দেখিয়েছে।

তাইওয়ান বলছে, চীন তাদেরকে ভূমি, সমুদ্র ও আকাশপথে অবরুদ্ধ করে ফেলতে চাইছে। যদি চীন তাইওয়ানের দাবি করা ১২ নর্টিক্যাল মাইল এলাকায় যুদ্ধজাহাজ কিংবা যুদ্ধবিমান পাঠায় তাহলে তা তাইওয়ানের মধ্যে ঢুকে আগ্রাসন চালানোর সামিল হবে। তখন তাইওয়ান হয়ত নিজের সীমানা রক্ষার্থে চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যান এবং চারটি যুদ্ধজাহাজ ফিলিপিন্স সাগরে মঙ্গলবার থেকেই সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ১৯৯৬ সালের সংকটের সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপকে তাইওয়ানের কাছাকাছি মোতায়েন করেছিলেন। আর স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের উপরে যে কোনও আঘাতের জবাব দিতে প্রস্তুত।

আর এবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি খোদ তাইওয়ানে গিয়ে তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। বলেছেন, যে কোনও সময়ের চেয়ে তাইওয়ানের পাশে থাকা এখন বেশি জরুরি। সেই বার্তা দিতেই তিনি এই সফর করেছেন।

কিন্তু তখনকার চীন আর এখনকার চীনের সামরিক শক্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ১৯৯৬ সালে চীন সামরিক দিক থেকে ছিল দুর্বল। কিন্তু আজ চীন নিজেও সামরিক পরাশক্তি। চীনের নিজেরই বিমানবাহী রণতরী রয়েছে এবং এই এলাকা চীনের হাতের মুঠোয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র কোনও সামরিক পদক্ষেপ নিলে চীনও পাল্টা জবাব দেবে তাতে সন্দেহ নেই।

তাছাড়া, সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কলিন কোহ বলছেন, এবার যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ানের অত্যাধুনিক নজরদারি বিমানগুলো চীনের সামরিক ব্যবস্থা ও যোগাযোগের ব্যাপ্তি খতিয়ে দেখতে তাদের সামরিক মহড়ার ওপর নজর রাখবে। এ পরিস্থিতিতে চীনের বিমান কোনও সামরিক পদক্ষেপ নিলে তাও বড় ধরনের সংঘাতের বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।

তাই চীনের এবারের সামরিক মহড়া যে আর দশটা মহড়ার মত হতে যাচ্ছে না তা বলাই যায়। পূর্ণ মাত্রার সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এই মহড়া। আর তাইওয়ানের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তার উত্তর হয়ত এই ছয় দিনেই পাওয়া যাবে।