অর্থনীতি ও ভোক্তার ওপর এর প্রভাব নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে, তা বিশ্বের অনেক দেশের মত যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বাজারকেও নাড়া দিচ্ছে।
Published : 13 Mar 2025, 12:16 PM
ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপের সবশেষ পদক্ষেপের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডা পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ায় আরও শুল্ক আরোপের অঙ্গীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি অবশ্যই পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন। আগামী মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর ‘পাল্টা’ শুল্ক হার প্রকাশ করবেন।
“তারা আমাদের দিকে যা ছুড়বে, আমরা তাই ফেরত দেব।”
বিবিসি লিখেছে, এই হুমকি বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তেজনা আরও তীব্র করেছে। আর তাতে অর্থনীতি ও ভোক্তার ওপর প্রভাব নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি করেছে, তা বিশ্বের অনেক দেশের মত যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বাজারকেও নাড়া দিয়েছে।
ট্রাম্প বুধবার ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর মার্কিন শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেন, আরোপ করেন ২৫ শতাংশ শুল্ক। সেই সঙ্গে কিছু দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আমদানি শুল্কছাড় সুবিধা প্রত্যাহার করেন।
তার আগে চলতি মাসের শুরুর দিকেই এক আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ২০ শতাংশে উন্নীত করা হয়।
তামা, কাঠ, গাড়িসহ যেসব পণ্য কোনো দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুল্ক আরোপ করা হয়, সে ধরনের পণ্যেও শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প।
কানাডা ও ইউরোপের নেতারা ধাতুর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ককে অযৌক্তিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক বসিয়েছেন।
অবশ্য যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশ, যারা যুক্তরাষ্ট্রে ধাতু সরবরাহ করে, তারা তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, “ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক দেখে অন্য সবার মত আমিও হতাশ। তবে আমরা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেব।
“আমরা একটা সমঝোতার চেষ্টা করছি, যেখানে শুল্কের বিষয়টাও থাকবে, যদি আমরা সফল হতে পারি। আমরা সব বিকল্পই আলোচনায় রাখব।”
‘ব্যবসার জন্য খারাপ, ভোক্তার জন্য আরো খারাপ'
কানাডা জানিয়েছে, তারা ইস্পাত, কম্পিউটার, খেলার সামগ্রীসহ প্রায় ৩০ বিলিয়ন কানাডীয় ডলারের মার্কিন পণ্যে বৃহস্পতিবার থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ শুরু করবে।
কানাডার হবু প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, ট্রাম্প যতক্ষণ ‘কানাডার সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা’ দেখাবেন, ততক্ষণ নতুন একটি বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চালিয়ে যেতে তিনি রাজি।
ইইউ জানিয়েছে, তারা ১ এপ্রিল থেকে নৌকা, বার্বন, মোটরবাইকসহ ২৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যে শুল্ক বাড়াবে।
ইইউ প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লায়েন বলেছেন, তারা চেয়েছেন, তাদের জবাব যেন ‘শক্তিশালী, কিন্তু সঙ্গতিপূর্ণ’ হয়। আর ইইউ ‘অর্থবহ’ সংলাপে বসতেও প্রস্তুত রয়েছে।
“শুল্ক হচ্ছে কর। সেটা ব্যবসার জন্য খারাপ, ভোক্তাদের জন্য আরো খারাপ,” বলেন তিনি।
বাজারের এই অস্থিরতা যে কর্মসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলবে, জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দেবে, সে বিষয়ে সতর্ক করে ইইউ প্রেসিডেন্ট বলেছেন, “এটাতো কারোরই দরকার ছিল না; না ইউরোপীয় ইউনিয়নের, না যুক্তরাষ্ট্রের।”
ট্রাম্পের ভাষ্য, তিনি দীর্ঘমেয়াদে তার দেশে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম উত্পাদন বাড়াতে চান। আর সে কারণেই এসব পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বসিয়েছেন।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই আমদানি শুল্ক তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন ভোক্তাদের কাছে দাম বাড়ার কারণ হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেবে।
রয়টার্স জানিয়েছে, কোয়েকার ওটস, ফলজার্স কফির মত প্যাকেটজাত খাদ্য প্রস্তুতকারকরা ট্রাম্পের কাছে কোকো ও ফলের মত পণ্যে শুল্কছাড় চেয়েছে। এরকম একটি চিঠিও তারা দেখেছে।
পেপসিকো, কোনাগ্রা এবং জে এম স্মুকারের মত কোম্পানি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছে, তাদের পণ্যের যেসব উপাদান যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায় না, সেসবে যাতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়। বাণিজ্য সংগঠন কনজুমার ব্র্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে এই অনুরোধ জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কফি, ওটস, কোকো, মশলা, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল এবং খাদ্য ও গৃহস্থালি পণ্যের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত টিন মিল স্টিল যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয় না, সেগুলো আমদানি করতে হয়।
শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের চাহিদাও কমে যাবে, যা হবে ধাতু উৎপাদনকারীদের জন্য বড় ধাক্কা।
ইইউর হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মোট রপ্তানির ৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে কানাডা যে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানি করে, তার প্রায় ৯০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে।
এদিকে শুল্ক নিয়ে অস্থিরতায় দুই দিন বড় পতনের পর বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে মিশ্রভাব দেখা গেছে। ডাউ জোনস সূচক কমেছে ০.২ শতাংশ, আর এস অ্যান্ড পি সূচক বেড়েছে ০.৫ শতাংশ এবং নাসডাক সূচক বেড়েছে ১.২ শতাংশ।
হোয়াইট হাউজে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য নীতিতে তিনি ‘খুশি নন’।
অ্যাপলের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের জরিমানা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ইউরোপের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি ও খাদ্যপণ্য অসুবিধায় পড়েছে।
তিনি বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য তাদের যা করা উচিত, সম্ভবত সেটাই তারা করছে; কিন্তু সেখানে একটা অশুভ ইচ্ছা তৈরি হচ্ছে।”
ইউরোপীয় গাড়িতে শুল্ক আরোপের হুমকির পুনরাবৃত্তি করে পরে ট্রাম্প বলেছেন, “আমরা এই আর্থিক যুদ্ধে জিততে যাচ্ছি।”