বছর চারেক আগে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরা তালেবান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
Published : 09 Mar 2025, 05:04 PM
তালেবানের দমননীতি থেকে বাঁচতে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া ৮০ জনের বেশি আফগান নারী এখন নিজ দেশে ফেরা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
ওমানে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থীর জন্য দেওয়া মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচিতে ব্যাপক কাটছাঁটের নির্দেশ দেন। তারই অংশ হিসেবে ইউএসএআইডির অর্থায়ন স্থগিত হওয়ায় ওই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি বাতিল হয়েছে।
“এটা হৃদয়বিদারক। সবাই হতবাক, খবরটা পেয়ে আমরা কেঁদেছি। আমাদের জানানো হয়েছে যে দুই সপ্তাহের মধ্যেই দেশে ফেরত পাঠানো হবে,” নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন।
বছর চারেক আগে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরা তালেবান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
ওমানে থাকা শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের দেশে ফেরানোর প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটা ঠেকাতে ‘দ্রুত হস্তক্ষেপ’ চেয়ে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধও করে যাচ্ছেন।
৮২ আফগান শিক্ষার্থীর কাছে পাঠানো ইমেইল পর্যালোচনা করে দেখেছে বিবিসি। ওই ইমেইলগুলোতে তাদের বৃত্তি বন্ধ হওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানোর খবর শিক্ষার্থীদের আতঙ্কগ্রস্ত করবে- এমনটা অনুধাবন করে বৃত্তি বন্ধের খবর যে ‘গভীর হতাশা ও দুশ্চিন্তা’ সৃষ্টি করতে পারে ইমেইলে তা স্বীকারও করে নেওয়া হয়েছে।
“আমাদের এখনই তাৎক্ষণিক সুরক্ষা, আর্থিক সহায়তা ও নিরাপদ কোনো দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ প্রয়োজন, যেখানে আমরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবো,” বলেছেন এক শিক্ষার্থী।
ইউএসএআইডি-এর ওয়েবসাইটের মিডিয়া কন্টাক্ট পেজটি বর্তমানে অকার্যকর রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য চেয়ে বিবিসি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দিক থেকে সাড়া পায়নি।
যে আফগান তরুণীরা দেশে ফেরা নিয়ে আতঙ্কে, তারা ইউএসএআইডির ‘উইমেনস স্কলারশিপ এনডাওমেন্ট (ডব্লিউএসই)’ কর্মসূচির আওতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনে ওমানে এসেছিলেন।
২০১৮ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচির আওতায় আফগান নারীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
২০২১ সালে যখন তারা এই বৃত্তির জন্য মনোনীত হন, তখনও তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেনি। অনেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনাও চালিয়ে যান, ওই মাসেই তালেবান দেশটিতে নারীদের উচ্চশিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
১৮ মাস দোটানায় থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে তারা পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
পরে ইউএসএআইডি-এর সহায়তায় তারা ওমানের ভিসা পান এবং ২০২৪ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরের মধ্যে সেখানে পৌঁছান।
“যদি আমাদের ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। ফিরে গেলে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। আমরা আর পড়তে পারব না, পরিবার হয়তো জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। আমাদের অনেকেই অতীতে নানা সংগঠন বা অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে,” বলেছেন এক শিক্ষার্থী।
তালেবান ক্ষমতা দখলের পর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার চেয়ে প্রতিবাদ করা অনেক নারীকে আটক, নির্যাতন ও হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
আফগানিস্তানে থাকা নারীরা নিজেদেরকে বর্ণনা করেন ‘চলাফেরা করা মৃত মানুষ’ বলে।
তালেবান সরকার বলছে, তারা নারীশিক্ষা সংক্রান্ত ইস্যুগুলো সমাধানের পথ খুঁজছে। একইসঙ্গে তারা তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার ফতোয়ারও দোহাই দিচ্ছে। বলছে, যা-ই করা হচ্ছে তা ‘শরিয়া আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ’।
“আফগানিস্তানে এখন চরম জেন্ডার বৈষম্য চলছে। নারীদের পদ্ধতিগতভাবেই শিক্ষাসহ নানান মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে,” বলেছেন এক শিক্ষার্থী।
এই দুর্ভাগ্য এড়াতেই তিনি এবং তার বন্ধুরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ওমানে পড়তে এসেছিলেন। যে বৃত্তির আওতায় এসেছিলেন, তাতে তাদের ২০২৮ পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকার কথাই ছিল না।
“যখন আমরা এখানে এসেছিলাম, আমাদের পৃষ্ঠপোষকরা আমাদের বলেছিল, ২০২৮ সাল পর্যন্ত ছুটি কাটাতে কিংবা পরিবারের সাথে দেখা করতেও আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না, কারণ সেটা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আর এখন তারা আমাদের ফিরে যেতে বলছে,” বলেছেন ওই তরুণী।
গত মাসে হোয়াইট হাউজের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আনা কেলি ওয়াশিংটন পোস্টকে আফগান নারীদের এমন দুর্দশার জন্য ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিপর্যয়কর মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে দায়ী করেছিলেন। বলেছিলেন, “বাইডেনের সিদ্ধান্তের ফলেই তালেবান মধ্যযুগীয় শরিয়া আইন চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।”
অথচ মার্কিন সহায়তা কার্যক্রমে বড় ধরনের কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন ট্রাম্প প্রশাসন, এটা বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ধনকুবের ইলন মাস্ক নেতৃত্বাধীন ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি।
তাদের কারণে মাত্র কয়েক মাস আগে ওমান পৌঁছানো এই আফগান তরুণীদের এখন সারাক্ষণ কাটছে শঙ্কায়। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের দরকার নিশ্চয়তা, আশ্রয়; তালেবানের দেশে ফিরে যেতে হবে না, পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ মিলবে- এমন আশ্বাস।