বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহটির বায়ুমণ্ডল দেখে সেখানে প্রাণ সংশ্লিষ্ট দুটি গ্যাসের অন্তত একটির রাসায়নিক চিহ্ন আছে বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে এ গ্যাসগুলো পাওয়া যায় সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও ব্যাকটেরিয়াতে।
Published : 17 Apr 2025, 04:47 PM
অন্য একটি তারাকে ঘিরে ঘুরতে থাকা বহুদূরের এক গ্রহে সম্ভাব্য প্রাণের অস্তিত্ব সংক্রান্ত ‘নতুন ও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ’ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কে২-১৮বি নামে ডাকা গ্রহটির বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিজ্ঞানীদের দাবি, তারা সেখানে এমন অনুর চিহ্ন পেয়েছেন, পৃথিবীতে যেগুলো কেবল ক্ষুদ্র সরল অনুজীবেই মেলে।
নাসার জেমস ওয়েব মহাকাশ টেলিস্কোপের (জেডব্লিউএসটি) সাহায্যে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ও ‘আগের তুলনায় বেশি সম্ভাবনাময়’ প্রাণ সংশ্লিষ্ট রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেল, বলছে বিবিসি।
তবে ক্যামব্রিজের গবেষক দল এবং অন্যান্য স্বাধীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও বলছেন, ফলাফল নিশ্চিত হতে আরও তথ্যের প্রয়োজন।
গবেষক দলের প্রধান নিক্কু মধুসুধন বলেছেন, শিগগিরই বলার মতো দৃঢ় প্রমাণ পাবেন বলে তিনি আশাবাদী।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক নিক্কু মধুসূদন বলেন, “সেখানে সম্ভাব্য প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ। বাস্তবতা বিবেচনায় বলতে পারি, এক থেকে দুই বছরের মধ্যে আমরা এই সংকেতের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারবো।”
কে২-১৮বি গ্রহটি পৃথিবীর তুলনায় আড়াই গুণ বড়, আমাদের থেকে এটি ৭০০ ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি) মাইল দূরে অবস্থিত।
নাসার জেডব্লিউএসটি টেলিস্কোপটি এতই শক্তিশালী যে তা কে২-১৮বি যে লাল সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হয় তার মধ্য দিয়ে আসা আলো থেকে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারে।
ক্যামব্রিজের গবেষক দলটি বলছে, গ্রহটির বায়ুমণ্ডল দেখে সেখানে প্রাণ সংশ্লিষ্ট দুটি অনুর অন্তত একটির রাসায়নিক চিহ্ন আছে বলে মনে হচ্ছে। প্রাণ সংশ্লিষ্ট যে দুটি রাসায়নিক উপাদানের কথা বলা হচ্ছে, এগুলো হলো- ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস) ও ডাইমিথাইল ডাইসালফাইড (ডিএমডিএস)।
পৃথিবীতে এ গ্যাসগুলো পাওয়া যায় সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও ব্যাকটেরিয়াতে।
কেবল একবার পর্যবেক্ষণে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে এ ধরনের বিপুল পরিমাণ গ্যাস দেখে বিস্মিত মধুসূদন।
“আমাদের অনুমান যা বলছে, গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে যদি সত্যিই এ পরিমাণ গ্যাস থাকে, তা হবে পৃথিবীর তুলনায় কয়েক হাজার গুণ। আর এর সঙ্গে যদি সত্যিই প্রাণের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে বলতে হবে ওই গ্রহটিতে প্রাণ গিজগিজ করছে,” বলেছেন তিনি।
“যদি আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে কে২-১৮বি’তে প্রাণের অস্তিত্ব আছে, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে ওই ছায়াপথে আরও প্রাণের অস্তিত্ব আছে,” বলছেন এই বিজ্ঞানী।
অবশ্য এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে যে এখনও অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’ আছে তা অস্বীকার করছেন না তারা।
প্রথমত, একে আবিষ্কার বলতে গেলে বিজ্ঞানীদের তাদের প্রাপ্ত ফল সম্বন্ধে ৯৯.৯৯৯৯৯% নিশ্চিত হতে হবে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ফাইভ সিগমা ফল।
তারা এখন যেটি পেয়েছেন সেটি হচ্ছে- থ্রি সিগমা, ৯৯.৭%। অনেক বেশি মনে হলেও এই ফল বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো নয়।
কিন্তু ফাইভ সিগমা ফল নিশ্চিত করা গেলেও তা গ্রহটিতে প্রাণের অস্তিত্ব আছেই এমনটা অকাট্যভাবে বলতে পারবে না।
তখন আসবে গ্যাসটির উৎস কী, সেই প্রশ্ন—বলছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কটল্যান্ডের অ্যাস্ট্রোনমার রয়েলের অধ্যাপক ক্যাথেরিন হেইম্যানস।
“পৃথিবীতে না হয় এটি সমুদ্রে থাকা অনুজীব থেকে হয়, কিন্তু নিখুঁত উপাত্ত পেলেও তো আমরা ভিন গ্রহের ওই গ্যাস যে কোনো প্রাণী থেকেই আসছে তা তো নিশ্চিত হতে পারছি না। কারণ, মহাবিশ্বে প্রচুর অদ্ভুত ঘটনা ঘটে এবং আমরা আদৌ জানি না যে ওই গ্রহে এমন কোন ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপ ঘটছে কিনা, যা ওই অণু তৈরি করতে পারে,” বলেছেন তিনি।
তার এ সন্দেহের সঙ্গে ক্যামব্রিজের গবেষক দলও একমত। তারা এখন অন্য কিছু দলের সঙ্গে গবেষণাগারে অন্য কোনো উপায়ে ডিএমএস ও ডিএমডিএস উৎপন্ন করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখছেন।
এই গ্যাসগুলো আদৌ ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে আছে কিনা, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যেমন তর্ক-বিতর্ক চলছে, তেমনি চলছে গ্রহটির গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও।
একদল গবেষকের অনুমান, গ্রহটিতে বিশাল এক সমুদ্র থাকায় কে২-১৮বি’র বায়ুমণ্ডলে অ্যামোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি নেই। তাদের মতে, নিচে থাকা বিপুল পরিমাণ পানি ওই অ্যামোনিয়া শুষে নিয়েছে।
তবে ক্যামব্রিজেরই অধ্যাপক অলিভার শর্টেল বলছেন, ওই সমুদ্র গলিত লাভারও হতে পারে, তেমনটা হলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার কথা না।
নাসার আমেস রিসার্চ সেন্টারের ড. নিকোলাস ওগান আবার মনে করেন, কে২-১৮বি আদতে একটি ছোটখাটো গ্যাসের আধার, যার কোনো তল নেই।
তবে এসব ধারণার সঙ্গে জেডব্লিউএসটিতে পাওয়া অনেক উপাত্তের মিল পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক মধুসূদন জানেন, তাকে এখনও আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে তিনি ও তার দল ‘ঠিকপথেই আছেন’ বলে তার বিশ্বাস।
তাদের গবেষণার ফল অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল লেটারে প্রকাশিত হয়েছে, বলেছে বিবিসি।