পাকিস্তানে চলমান আন্দোলন সেনাবাহিনী বিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিচ্ছে?

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ইমরান ও তার দলের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2023, 02:07 PM
Updated : 11 May 2023, 02:07 PM

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের জেরে তার দলের কর্মীসমর্থকদের তীব্র আন্দোলনে টালমাটাল পাকিস্তান। আন্দোলন যেদিকে এগুচ্ছে, তাতে যে কোনো সময় তা দেশটির প্রভাশালী সেনাবাহিনী বিরোধী বিক্ষোভের রূপ নিতে পারে।

যদি তাই হয়, তবে তা অর্থনৈতিকভাবে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দেবে।

গত মঙ্গলবার দুইটি মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকতে ইসলামাবাদের হাই কোর্টে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু আদালত প্রাঙ্গন থেকে নাটকীয়ভাবে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশটির ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো-এনএবি।

পরে জানানো হয়, তাকে আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে মামলায় পরদিন তার আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে একটি দুর্নীতি দমন আদালত।

ইমরানকে গ্রেপ্তারের পরপরই রাস্তায় নেমে আসেন তার কর্মীসমর্থকরা। শুরু হয় জ্বালাওপোড়াও। পাকিস্তানের বেশিরভাগ বড় শহরেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি সেনানিবাস, জেনারেল হেড কোয়ার্টাস রাওয়ালপিন্ডি এবং ফ্রন্টিয়ার কর্পস এর কয়েকটি কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। সেনাসদস্যদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানায় পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার সংবাদ মাধ্যম ডন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাবাহিনী বিরোধী হ্যাসট্যাগ চালু হয়েছে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অত্যন্ত প্রভাবশালী। যারা দীর্ঘ সময় ধরে দেশটির ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করেছে।

১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বরাবরই অস্থিতিশীল, এখন পর্যন্ত দেশটিতে কোনো প্রধানমন্ত্রী নিজের দায়িত্বের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি।

ইমরানকেও তার মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন।

তখন সাবেক এই ক্রিকেটার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিকে আঙ্গুল তুলেছিলেন।

যদিও একসময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই নেতার বেশ দহরম-মহরম ছিল। এমনও বলা হতো, সেনাবাহিনীর ইচ্ছাতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

অবশ্য পাকিস্তানের ক্ষমতায় কে থাকবে আর কে থাকবে না সেই সিদ্ধান্তে ঐতিহ্যগতভাবেই সেনাবাহিনী বড় ভূমিকা রেখে আসছে।

ইমরানকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখনও তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থকরা সেনাবাহিনী বিরোধী স্লোগান দিয়েছিল।

এবারের বিক্ষোভ নিয়ে এরইমধ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ইমরান ও তার সমর্থকরা ‘চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করছে’। সেনাবাহিনীর সম্পত্তি ও স্থাপনায় ‘পরিকল্পিতভাবে হামলা’ করা হচ্ছে এবং ‘সেনাবাহিনী বিরোধী স্লোগানও বাড়ছে’।

বুধবার আইএসপিআর এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনী এবং সেনা ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও সম্পত্তিতে আর কোনো ধরণের আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

‘‘এর পুরো দায় ওই দলের উপর বর্তাবে যারা পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে।”

তলানিতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, তীব্র জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর বাড়তে থাকা তৎপরতার কারণে আগে থেকেই পাকিস্তানের ২২ কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে আছে। রাজনৈতিক শৃঙ্খলা তো সেখানে কোনোদিন ছিলই না।

কিন্তু নির্বাচনের বছরে ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দেশটিতে নতুন করে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই দেশটিকে ঘোরতর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ইমরানকে এর আগেই বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সমর্থকদের বাধার কারণে পুলিশ বার বার ব্যর্থ হয়েছে।

ইমরান শুরু থেকেই বারবার অভিযোগ করেছেন, তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই এত মামলা এবং গ্রেপ্তারের চেষ্টা।

কেনো গ্রেপ্তার হলেন ইমরান?

ইমরানকে মঙ্গলবার আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। দুইটি মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকতে ওইদিন তিনি ইসলামাবাদের হাই কোর্টে গিয়েছিলেন।

গ্রেপ্তারের পরদিন তোষাখানা মামলায় তাকে অভিযুক্তও করা হয়। এই তোষাখানা মামলাতেই পরপর তিনবার আদালতে শুনানিতে অনুপস্থিত থাকার কারণে ইমরানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল এবং পুলিশ একাধিক বার তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টাও করে।

ইমরান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার দলের পক্ষ থেকে ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। আগে রেকর্ড করা ওই ভিডিওতে ইমরান তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনাদের সবার নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে।”

পাকিস্তানে কী হচ্ছে?

ইমরানকে গ্রেপ্তারের পরপরই পকিস্তানজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ শুরু করেছেন তার দলের কর্মীসমর্থকরা। এরই মধ্যে মুখোমুখি বিক্ষোভকারী ও সেনাবাহিনী, বাড়ছে উত্তেজনা, ছড়াচ্ছে অজানা শঙ্কা।

সবচেয়ে বড় আকারে বিক্ষোভ হচ্ছে লাহোর ও পেশওয়ারে। এই দুই নগরী ইমরানের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। লাহোর ও পেশওয়ারে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। হয়েছে রক্তপাত।

শত শত বিক্ষোভকারী পেশওয়ারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বেতারের সদরদপ্তরে ভাংচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে জানায় ডন।

স্থানীয় প্রশাসন থেকে বলা হয়, সেখানে সংঘাতে অন্তত আট জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ।

খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সাড়ে ছয়শ’র বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে।

সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য পাঞ্জাবে পিটিআই এর প্রায় এক হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

দেশের সব বেসরকারি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ পাকিস্তান ভ্রমণ বিষয়েও সতর্কতা জারি করেছে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে সরকার দেশজুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত রেখেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রবেশ করতে সমস্যা হচ্ছে।

তিনটি প্রদেশে সব ধরণের জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামাবাদ ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

কেনো বিক্ষোভের লক্ষ্য সেনাবাহিনী?

ইমরান খানকে উৎখাতের পর থেকেই তার সমর্থকরা সেনাবাহিনী-বিরোধী স্লোগান দিয়ে আসছে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুবই প্রভাশালী খেলোয়াড় এই সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী নানা সময়ে দেশটির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। বেশ কয়েকবার সরাসরি দেশ শাসন করেছে।

অতীতে রাজনীতিকরা কখনও সখনও সেনাবাহিনীর এই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানালেও বর্তমান পরিস্থিতি সেসব থেকে ভিন্ন বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এ পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন ‘ইমরানের সমর্থকরা।

ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের পাকিস্তানি ফেলো সৈয়দ বাকির সাজ্জাদ বলেন, ‘‘শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে ইমরান যে উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন অর্জন করেছেন তা সত্যিই অনন্য। এই শ্রেণীটি ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সঙ্গে একেবারেই জড়িত ছিল না।

‘‘সেনাবাহিনীর উপর ইমরানের আক্রমণের তীব্রতা ও ধারাবাহিকতা, বিশেষ করে গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে; তা সত্যিই নজিরবিহীন।”

ইমরান বার বার তার ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছেন। এমনকি, গত বছর নভেম্বরে জনসমাবেশ চলাকালে তাকে গুলি করার ঘটনার পেছনে সরাসরি একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার নাম নিয়েছেন তিনি।

ইমরানের এমন দাবির কারণেই তার সমর্থকদের বিক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে সেনাবাহিনী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা।

এর পর কী?

ইমরান এখন এনএবির হেফাজতে আছেন। তারা তাকে আট দিনের রিমান্ডে পেয়েছেন।

এদিকে, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট ইমরানের গ্রেপ্তারকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে বলে খবর জিও নিউজের। ইমরানকে আরও একবার ইসলামাবাদ হাই কোর্টে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

যা তার সমর্থকদের জন্য চরম স্বস্তির। ইমরানের দাবি অনুযায়ী, তাকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করতেই বর্তমান জোটসরকার এসব করছে এবং সেনাবাহিনীও ‘সেই চক্রান্তে সামিল’।

ইমরানকে কী আসলেই দমিয়ে রাখা সম্ভব?

Also Read: ইমরান খান: রাজনীতির খেলায় হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায়

Also Read: ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতিতে পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ

Also Read: অবৈধ সুবিধা চেয়েছিলেন ইমরান খান, দাবি আইএসআই প্রধানের

Also Read: পাকিস্তানে ইমরানের দলের তুমুল বিক্ষোভ-সংঘর্ষ, পেশোয়ারে নিহত ৪