গাজায় জীবন বাঁচাতে গোলাবারুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা এই মানুষদের জন্য এখন নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে শীত। ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের।
Published : 03 Dec 2024, 07:55 PM
ঠিক এই সময়টা গাজার সমুদ্র সৈকতে দিনের বেলায় ভ্রমণের মত পরিস্থিতি নেই। কিন্তু তারপরও প্রাণ বাঁচাতে বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার মানুষকে এখন উপকূলেই বাস করতে হচ্ছে।
এই শীতকালে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বসবাস কতটা কঠিন সেটা হয়ত আমাদের উপলব্ধির বাইরে।
কিন্তু গাজায় জীবন বাঁচাতে গোলাবারুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা এই মানুষদের জন্য এখন নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে শীত। ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের।
বাস্তুচ্যুত হাজারও মানুষ প্রাণ বাঁচাতে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বসতি গাড়লেও ঠাণ্ডা তাদের কাবু করে ফেলছে। কারণ, নড়বড়ে তাঁবুর ঘর শীত ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
একটা ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় বিছানা, তোষক, বালিশ এমনকি খাবারও তারা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সমুদ্রের ঢেউ সবই কেড়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন, দেইর আল-বালাহের মোহাম্মদ আল-হালাবি।
তিনি আরও বলেন, “আমরা দুই মাসের একটি শিশুকে উদ্ধার করেছি। শিশুটি সমুদ্রের ঢেউয়ে প্রায় ভেসে যাচ্ছিল।”
গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় সবাই এখন বাস্তুচ্যুত এবং আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারীদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই তাঁবুতে রয়েছে, বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বহু মানুষ।
এমনকি বৃষ্টির পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। শায়মা ইসা নামের একজন খান ইউনিস থেকে বিবিসি-কে বলছিলেন, "ঠান্ডায় আমার সন্তানদের হাত পা সবকিছু জমে যাচ্ছে। ঠান্ডার কারণে আমার মেয়ের জ্বর হয়েছে। তাঁবুর ঘরে ঠাণ্ডা আটকাচ্ছে না। এখানে প্রায় সবাই অসুস্থ পড়ছে ঠান্ডায়। কারও কারও কাশি হয়েছে।”
"বৃষ্টি হলে আমাদের তাঁবুতে পানি ঢুকে যায়, আমরা ভিজে যাই," কাঁদতে কাঁদতে বলেন ইসার প্রতিবেশী সালওয়া আবু নিমার। তিনি আরও বলেন, "ভারি বৃষ্টিতে আমাদের এখানে পানি আটকে বন্যা হয়ে যায়। তাঁবুতে পানিও আটকায় না। তাঁবুতে পানি ঢুকে আমাদের জামাকাপড় ভিজে যায়। শুকনো খাবার নেই, পানি নেই, আশ্রয় নেই। এ কেমন জীবন যাপন করছি আমি,?” নিমার এভাবেই হতাশার কথা আওড়ান বিবিসি’র কাছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলেও জাতিসংঘ কর্মকর্তারা গাজাজুড়ে ওষুধ, খাদ্য, আশ্রয় ও জ্বালানির মারাত্মক ঘাটতির বিষয়ে সতর্ক করে পরিস্থিতিকে 'বিপর্যয়কর' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বিবিসি-র প্রতিবেদক জানান, কয়েকটি দাতব্য সংস্থার বেকারির বাইরে শত শত মানুষের উপস্থিতি ধরা পড়েছে তাদের ক্যামেরায়। কিন্তু প্রতিবেদক বলেন, তার জানা মতে বেকারী গুলোতে এখন পর্যাপ্ত খাবার নেই। মানুষ হুড়মুড় করে ছুটছে খাবার সংগ্রহের জন্য। সবার পেটেই খুদা।
"আমার একটা রুটি দরকার। আমার ব্যথা, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। মানুষের ভিড় ঠেলে আর আগাতে পারছি না; এত ভিড়ে আমি সামনে আগাতে ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব," বলেছেন হানান আল-শামালি, তিনি মূলত উত্তর গাজা থেকে এসেছেন।
আরেকজন বলেন, “প্রতিদিন সকালে আমি এখানে আসি। শেষ পর্যন্ত রুটি পাবো কি পাবো না জানিনা? মাঝে মাঝে পাই, কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই পাই না।”
গত সপ্তাহে গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধান সীমান্ত ক্রসিং কেরেম শালোম –এ সাংবাদিকরা ত্রাণবাহী গাড়ি যেতে দেখে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ত্রাণ প্রবেশের হার গত বছরের চেয়ে এখন সবচেয়ে কম। যদিও ত্রাণের সঠিক বণ্টন করতে না পারার জন্য ইসরায়েল দাতব্য সংস্থাগুলোকে দায়ী করে।
তবে গাজার মানবিক সহায়তা কর্মীরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান অরাজকতার মধ্যে সশস্ত্র দলগুলো কেরেম শালোম দিয়ে আনা ত্রাণ লুট করছে। ফলে এখন এই অঞ্চলে কর্মরত জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ত্রাণ সরবরাহের জন্য এ রুট ব্যবহার বন্ধ করতে বাধ্য করেছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির স্থানীয় প্রধান আন্তোইন রেনার্ড বলেন, সামগ্রিক চিত্র হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা 'অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামের' মুখোমুখি হচ্ছে। তিনি বলেন, “গাজায় এখন আমরা যে মাত্রার ক্ষুধা, ধ্বংসযজ্ঞ দেখছি, তা আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে খারাপ। মানুষ আর মানিয়ে নিতে পারছে না।”
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও যুদ্ধের শেষ নেই। কেবল ঠান্ডা আবহাওয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন দুর্ভোগ শুরু হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি