রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস কেবল এককভাবেই নয়, জোটগতভাবেও এগিয়েছে। বিজেপি’র দুরবস্থা নতুন রসদ জুগিয়েছে বিরোধী শক্তি ‘ইন্ডিয়া’কে।
Published : 06 Jun 2024, 07:46 PM
ভারতজুড়ে একসময় প্রবল অধিপত্য থাকলেও হঠাৎই নিজেদের কিছু ভুলের কারণে সমর্থন হারিয়ে ফেলা দল কংগ্রেস এবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটির প্রাণভোমরা রাহুল গান্ধী।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস কেবল এককভাবেই নয়, জোটগতভাবেও এগিয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের দখলে এসেছে ২৩৩ আসন; যেখানে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ইউপিএ জোট ১০০’রও কম আসন পেয়েছিল।
আর ২০১৯ সালে ৫২ টি আসন পাওয়া কংগ্রেস এবার এককভাবে ১০০’র মতো আসনে জিতেছে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে ২৯ শতাংশ আসনে দলটি সাফল্য পেয়েছে।বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে গেলে ৫৪৩টি আসনের অন্তত ১০ শতাংশ আসন জিততে হয়। গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও পায়নি। কিন্তু এ বার কংগ্রেস ৯৯ আসনে জিতে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পাচ্ছে।
নির্বাচনে বুধফেরত জরিপের তথ্য এমনকী মোদী ম্যাজিক পুরোপুরি অকার্যকর করে দিয়ে নিজেদেরকে তুলে ধরেছে কংগ্রেস। আর এক সময় ভারতের শক্তির কেন্দ্রস্থল বিজেপি এখন পুরোপুরি শরিক নির্ভর। বিজেপি’র এই দুরবস্থা নতুন রসদ জুগিয়েছে বিরোধী শক্তি ‘ইন্ডিয়া’কে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সকে (এনডিএ) টেক্কা দিয়ে ইন্ডিয়া ভবিষ্যতে সরকার গড়তে পারবে কিনা সামনে আসছে সে প্রশ্ন।
কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের ঘুরে দাঁড়ানোর পুরো কৃতিত্বই যাচ্ছে রাহুল গান্ধীর ঝুলিতে। কারণ,কংগ্রেসের করুণ দশার মধ্যেও তিনি প্রথমে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর, তার পরে মণিপুর থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন।
লোকসভা ভোটে ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, কংগ্রেসের পুনর্নির্মাণের ভিত তৈরি হয়ে গেছে। আর কংগ্রেসের নেতা হিসেবেও রাহুল গান্ধী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন, যিনি দলের প্রতিকূল পরিস্থিতি, ঘনিষ্ঠ নেতাদের দলত্যাগ, প্রবীণ নেতাদের বিদ্রোহর পরও নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ভারতীয় সংবিধান ও ‘গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য’ দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রাহুল গান্ধী। তার দল কংগ্রেস এবং জোট ইন্ডিয়ার জন্য এ এক বিশাল পুনরুত্থান। ভারতীয় এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিবিসি-কে বলেছেন, নির্বাচনের ফল বিস্ময়কর। বিরোধীরা অপ্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে একে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার দল বিজেপির জন্য রাজনৈতিক ও নৈতিক হার বলা হয়েছে। রাহুল গান্ধীও কটাক্ষ করে বলেছেন, দেশের জনগণ মোদী ও তার দলকে শাস্তি দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে।
দলের ভাল ফলে রাহুলের উচ্ছ্বাস এবং বিজেপিকে এমন কটাক্ষ করে কথা বলার পেছনে কিছু কারণ আছে। পেছন ফিরলে দেখা যায়, নির্বাচনী প্রচারের সময়গুলোতে বিরোধীপক্ষ পুরোপুরি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ছিল। আর ২ ডজনেরও বেশি আঞ্চলিক দল নিয়ে গঠিত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট বিস্ফোরণন্মুখ ছিল। এই জোট মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম কিনা তা নিয়ে তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন বিশেষজ্ঞরাও।
নির্বাচন এগিয়ে আসতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীপক্ষকে সংগ্রামের মুখে পড়তে হয়েছিল। দল এবং নেতাদের বিরুদ্ধে তল্লাশি শুরু করেছিল সরকারি সংস্থাগুলো। দুই মুখ্যমন্ত্রী যার মধ্যে আছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীও- তাদেরকে জেল দেওয়া হয়। আয়কর কর্তৃপক্ষ কংগ্রেসের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দেয়।
ভারতের মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো রাহুলের প্রতি বৈরি ছিল। রাহুল প্রচণ্ড সমালোচিত হচ্ছিলেন। নামকরা নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সবচেয়ে সমালোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরিণত হয়েছিলেন এক গুরুত্বহীন রাজনীতিবিদে।
গত বছর মানহানির অভিযোগে একটি ফৌজদারি মামলায় গুজরাটের একটি আদালত রাহুল গান্ধী অভিযুক্ত হন। এরপর লোকসভার সদস্যপদ হারান তিনি। এর তিন মাস পর লোকসভার সদস্যপদ অবশ্য আবার ফিরে পান রাহুল। এর পর থেকেই মূলত প্রধানমন্ত্রী মোদীর সমালোচনা এবং ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে রক্ষার কথা বলে আসছেন তিনি।ক্ষমতাসীন দলের সর্বাত্মক আক্রমণাত্মক ও হয়রানিমূলক প্রচারণার বাধা মোকাবেলা করে রাহুল সম্প্রতি কয়েকবছরে তার নিজের এবং দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। ইন্ডিয়া জোট গঠন এবং ভারত জোড়ো যাত্রা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে, মোদী নির্বাচনের আগে দিয়ে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন, ভয়ভীতি দেখানোর যে চর্চা শুরু করেছিলেন, নির্বাচনের ফলে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২ আসনও পায়নি বিজেপি। কারও সমর্থন ছাড়া চলা তো দূর, সরকারও গড়ারও উপায়ও তাদের নেই।
উত্তর প্রদেশেও ক্ষমতাসীন বিজেপিকে এবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে সমাজবাদী পার্টি। বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের এক বড় শরিক অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন এই সমাজবাদী পার্টি। ইন্ডিয়ার হাতে আছে আরও কয়েকটি শরিক দল। যারা নির্বাচনে ভাল ফল করেছে।
১৮টি বিরোধী দল রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’য়। মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর ‘ইন্ডিয়া’ শরিক এবং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ইন্ডিয়া’র পরিবার আরও বড় হবে, শক্তিশালীও হবে।
অন্যদিকে, বিজেপিকে কেন্দ্রে সরকার গড়ার জন্য এখন কেবল এনডিএ-এর শরিক টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু, জেডিইউয়ের নীতিশ কুমার এবং শিবসেনার (শিন্ডে) একনাথ শিন্ডের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে।
তাছাড়া, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার ফলে এখন মোদী শরিকদের নানা দাবি-দাওয়া মেটানোরও ফাঁদে পড়েছেন। অন্তর্দলীয় কোন্দলের কথাও শোনা যাচ্ছে।
বিজেপির এই দুর্বল অবস্থার মধ্যে লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর রণকৌশল ঠিক করতে বৈঠক করেছে ইন্ডিয়া। কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’র কি কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষমতা আছে? কী বলছে জোট সমীকরণ?
‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরির উদ্যোগ প্রথম নিয়েছিলেন জেডিইউ প্রধান নীতীশ কুমার। কিন্তু তাতে ‘ইন্ডিয়া’র কোনও লাভ নেই। কারণ নীতীশ লোকসভা ভোটের আগে জোট বদলে যোগ দিয়েছেন এনডিএতে। ফলে তার প্রাপ্ত আসন আপাতত এনডিএর হাতে।
ওদিকে, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি দিয়েছিলেন মমতা। লোকসভা ভোটের ফল বলছে, তৃণমূল ২৯টি আসন পেয়েছে।
‘ইন্ডিয়া’ জোট যাদের ছাড়া সম্ভব হত না, তারা হল কংগ্রেস। দেশের প্রধান বিরোধী মুখ তারা। দেশের প্রাক্তন শাসকদল। এ বছর কংগ্রেস অন্যান্য বিরোধী দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে লড়েছিল বাছাই করা কিছু আসনে। তারপরও প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা বেড়েছে তাদের।
সমাজবাদী পার্টি ছাড়াও তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকেও রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’য়। তারা এ বার লোকসভায় তামিলনাড়ুর ২২টি আসন পেয়েছে।
আরও আছে দিল্লি এবং পঞ্জাবের শাসক দল অরবিন্দ কেজরীওয়ালের নেতৃত্বাধীন আপ। যারা এ বারে দিল্লিতে একটি আসন না পেলেও পঞ্জাবে তিনটি আসন জিতেছে। অর্থাৎ এ পর্যন্ত ‘ইন্ডিয়া’র মোট প্রাপ্ত আসন দাঁড়াল ১৯০-এ। বিজেপির প্রাপ্ত আসনের থেকে ৫০ আসন কম। তবে এই সংখ্যা কেবল ইন্ডিয়ার পাঁচটি দলের প্রাপ্ত আসনের যোগফল।এ ছাড়া আছে মহারাষ্ট্রের মহাগঠবন্ধনের দুই দল উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা (উদ্ধব) এবং শরদ পওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপি (শরদ)। এরা পেয়েছে যথাক্রমে ৯টি এবং ৮টি আসন। অর্থাৎ মহারাষ্ট্র থেকে ‘ইন্ডিয়া’ পাচ্ছে ১৭টি আসন।
ইন্ডিয়া’র শরিক বামফ্রন্টের কিছু দলও। তারা হল সিপিআই, সিপিএম এবং আরএসপি। বামপন্থি এ দলগুলো থেকে মোট ৮টি আসন এসেছে ‘ইন্ডিয়া’য়। ওদিকে, বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবের দল আরজেডি ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিক। গত লোকসভায় বিহারে একটিও আসন না জেতা আরজেডি এ বার জিতেছে ৪টি আসন।
ঝাড়খণ্ডের শাসকদল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। হেমন্ত সোরেনের দল ‘ইন্ডিয়া’কে এই লোকসভায় দিয়েছে ৩টি আসন। রাজস্থানের আরএলপি এবং আরএলটিপিও রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’য়। দুই দলই রাজস্থানে দু’টি আসন জিততে পেরেছে।
দক্ষিণের আরও চারটি দল— তামিলনাড়ুর ভিসিকে, এমডিএমকে এবং কেরালার কেইসিএম এবং মুসলিম লিগ- সব মিলিয়ে আরও ৭টি আসন ‘ইন্ডিয়া’ পেয়েছে দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকে। এভাবে ২৩৩ টি আসন তারা পেয়েছে।
কেন্দ্রে সরকার গড়ার প্রয়োজনীয় সংখ্যা ২৭২ হওয়ায় ‘ইন্ডিয়া’র সরকার গড়তে হলে শুধু এনডিএ ভাঙালেই চলবে না, আরও ৩৯টি আসন জোটাতেও হবে।
এই ১১টি আসন জোটাতে হলে সাত জন নির্দল এবং আরেকটি দলের চার সাংসদকে প্রয়োজন ইন্ডিয়ার। অথবা অন্যান্য আঞ্চলিক দলের জেতা আরও ৭টি আসনকে নিজেদের দিকে আনতে হবে। কিন্তু ছোট ছোট এতগুলো দলকে এক জায়গায় এনে দেশ শাসন করা সম্ভব কিনা আছে সে প্রশ্ন।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তবে ইন্ডিয়া সম্ভবত এ মুহূর্তে এতদূর ভাবছে না। বুধবারের বৈঠকের পর ইন্ডিয়া বলেছে, আপাতত ঐক্যবদ্ধ বিরোধী হিসাবেই সংসদে থাকতে চায় তারা।
তবে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, আসলে ‘ইন্ডিয়া’অপেক্ষা করা এবং পরিস্থিতি নজরে রাখতে চাইছে। ধৈর্য্য ধরে দেখতে চাইছে আগামী দিনগুলোতে কি হয়।
রাজনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন, এখনই জোট বেঁধে সরকার গড়ার কথা বলে বিজেপি এবং এনডিএ শরিকদের সতর্ক করে তুলতে চাইছে না ইন্ডিয়া। সে জন্যই সরকার গড়ার ব্যাপারে এখনই উদ্যোগী হচ্ছে না তারা।
অনেকেরই বলছেন, শরিক নির্ভর বিজেপির অবস্থা খুব শিগগিরই কঠিন হয়ে উঠবে। বিজেপি জোট টিকিয়ে রাখতে শরিকদের চাহিদা মেনে নিতে বাধ্য হতে পারে। আর তখনই এনডিএ শরিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফয়দা তোলায় ভূমিকা রাখতে পারবে ইন্ডিয়া।
আপাতত সব ঠিক থাকলে এনডিএ-র প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শনিবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন মোদী। তবে এরপর ‘ইন্ডিয়া’ মোড় ঘোরানোর নতুন কোনও পরিকল্পনা করে কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে।