মার্কিন প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞায় ‘ঠেকানো যায়নি’ চীনকে

“এআই সিস্টেমের (কম্পিউটিং) ক্ষমতা প্রতি ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করতে হয়। তার ফলে দুইদেশের বাজারের মধ্য ক্রমবর্ধমান ভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকবে।”

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2023, 05:24 AM
Updated : 5 May 2023, 05:24 AM

চীনের সুপারকম্পিউটার নির্মাণে অগ্রগতি ঠেকাতে দেশটিতে মাইক্রোচিপ রপ্তানিতে মার্কিন কড়াকড়ির তেমন একটা প্রভাব পড়ছে না।

সুপারকম্পিউটারের নানা ব্যবহারের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণা ও চ্যাটজিপিটির মতো এআই সিস্টেম তৈরিও রয়েছে। মার্কিন প্রশাসন গত বছর  সেই দৌড়ে চীনকে কোনঠাসা করতে, মার্কিন চিপ রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলোর উপর কড়াকড়ি আরোপ করে। বিষেজ্ঞরা বলছেন, ওই উদ্যোগে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।

রুল জারি করে এনভিডিয়া কর্পোরেশন এবং এডভান্স মাইক্রো ডিভাইসেস ইনকরপোরেশন, এই দুই প্রধান চিপ নির্মাতা কোম্পানির কয়েকটি চিপ হয়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে এআই গবেষণার ‘স্ট্যান্ডর্ড’। এই মডেলগুলো চীনে রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে মার্কিন সরকার।

সরকারি সেই আদেশ মানতে গিয়ে এনভিডিয়া নতুন মডেলের চিপ তৈরি করে, শর্ত মেনে এগুলোর গতি কমিয়ে দিয়ে। চীনের বাজার লক্ষ্য করে বানানো সর্বশেষ সংস্করণের এনভিডিয়া এইচ৮০০ চিপ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা দিয়ে এআই নিয়ে গবেষণা করতে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত এনভিডিয়ার চিপগুলোর তুলনায় শতকরা ১০ থেকে ৩০ ভাগ সময় বেশি লাগবে, আর ক্ষেত্র বিশেষে খরচ পড়বে দ্বিগুণ।

বিধিনিষিধের চক্করে জন্ম নেওয়া কমক্ষমতার নতুন এনভিডিয়া চিপেও আটকাবে না চীনা টেক কোম্পানিগুলোর উন্নতি, এমনটাই মনে করছে চীনের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি টেনসেন্ট হোল্ডিংস। তারা বলছে, বর্তমানে চীনে ব্যবহৃত চিপের সাথে তুলনায় এআই সিস্টেম কে ট্রেনিং দিতে সময় কমে আসবে অর্ধেকেরও কম, ১১ দিন থেকে চার দিন।

সাংহাইভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ৮৬রিসার্চের চার্লি চাই জানান “কোম্পানিগুলোর সাথে কথা বলে দেখা গেছে, এই কড়াকড়িকে তারা মনে করছে অতো সিরিয়াস নয়, এবং সামাধানযোগ্য”

সরকার ও টেক ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে চলমান টানাপোড়েন এক ধরনের উভয় সংকট তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। চীনকেও ঠেকাতে হবে আবার একইসঙ্গে দেশটিতে ব্যবসা করা আমেরিকান কোম্পানিগুলোর লোকসান করানো যাবে না।

পুরোপুরো নিষেধাজ্ঞা দিলে যদি চীন নিজেই চিপ তৈরি শুরু করে নিজেদের সক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে নিতে পারে, তবে তা হবে উভয়সঙকট। সেটি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র আংশিক নিষেধাজ্ঞার পথে হেঁটেছে।

“তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের কোম্পানিগুলোর লোকসান না করে চীনের সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে চাইলে মাঝামাঝি কোন একটা সমধানের পথ খুঁজে বের করতে হতো।” নাম গোপন রাখার শর্তে মার্কিন চিপ শিল্পের একজন নির্বাহী সরকারের সাথে তাদের আলোচনা নিয়ে এমনটাই বলেছেন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে।

রপ্তানি সীমিতকরণের ছিলো দুটো অংশ। প্রথম অংশে ছিলো, চিপে বানানো সুপার কম্পিউটার দিয়ে যেন সামরিক গবেষণা করা না যায়, সেজন্য চিপের সক্ষমতা পুঙ্খানুপুঙ্খ সংখ্যায় নির্ধারণ করে দেওয়া। চিপ কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায় এই সিদ্ধান্তটি ছিলো খুবই কার্যকরী।

চীনে রপ্তানি অনুমোদিত চিপের সক্ষমতা কাঁটায় কাঁটায় বেঁধে দেওয়াতে চীনের এআই গবেষণায় খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ লার্জ ল্যঙ্গুয়েজ মডেলনির্ভর এআই প্রযুক্তিগুলোতে কতটা সূক্ষ্মভাবে ডেটা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে তার চেয়েও বেশি জরুরী কত বেশি ডেটা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

টেনসেন্ট, আলিবাবা ও বাইডু কর্পোরেশনের মতো চীনা কোম্পানিগুলো এনভিডিয়ার এই নতুন এইচ৮০০ চিপটি দিয়ে এআই পরীক্ষা চালাচ্ছে। যদিও চিপটির এখন পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় রপ্তানি শুরু হয়নি।

এনভিডিয়ার প্রধান বিজ্ঞানী বিল ড্যালি বলেন, “এআই সিস্টেমের (কম্পিউটিং) ক্ষমতা প্রতি ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করতে হয়। তার ফলে দুইদেশের বাজারের মধ্য ক্রমবর্ধমান ভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকবে।”

মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ইন্ডাস্ট্রি সিকিউরিটি ব্যুরোর একজন মুখপাত্রের কাছে এ বিষয়ে জানাতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।

গতি কমেছে কিন্তু বন্ধ হয়নি

রপ্তানি সীমিতকরণ নীতির দ্বিতীয় অংশ হলো চিপ থেকে চিপে ডেটা ট্রান্সফারের গতি কমিয়ে আনা। চ্যাটজিপিটির মতো বড় প্রযুক্তিগুলো একটা মাত্র চিপে আঁটানো যায় না, কয়েক হাজার চিপকে সংযুক্ত করে এমন একটা সিস্টেম বানাতে হয়। প্রতিনিয়ত এই চিপগুলোর মধ্য আন্তঃযোগাযোগ ঘটাতে হয়।

এনভিডিয়া কেবল চীনের জন্য বানানো এইচ১০০ চিপের সক্ষমতার বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। কিন্তু রয়টর্স বলছে, এই সংস্করণটির ডেটা ট্রান্সফার রেট সেকেন্ডে চারশো গিগাবাইট বলে দেখা গেছে এর স্পেসিফিকেশন শিটে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত সংস্করণ এইচ১০০ এর বেলায় তা প্রতি সেকেন্ডে ৯০০ গিগাবাইট।

এআই জগতের কেউ কেউ এখনো একে যথেষ্ট গতি হিসাবেই দেখছেন। এআই প্রযুক্তিসেবা সহায়তাকারী কোম্পানি মোসাইকএমএল এর প্রধান নির্বাহী নাভিন রাও বলছেন, এখন আগের চেয়ে শতকরা ১০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি সময় লাগবে।

“অ্যালগরিদম দিয়ে এটা কমিয়ে আনা সম্ভব।”

তিনি আরো বলেন. “দীর্ঘ মেয়াদে যেমন ১০ বছরের মধ্যে সেটা আর কোন বিষয়ই থাকবে না।”

চীনের জন্য বানানো মাইক্রোচিপগুলোর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সংস্করণগুলোর চাইতে দ্বিগুণ সময় লাগলেও কাজ চলছে। “এমন অবস্থায় আগে ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হলে এখন ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে” সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এ প্রসঙ্গে এমনটাই বলছিলেন।

“এটা কি কোন সমস্যা? হয়তো সমস্যা। কিন্তু আলিবাবা বা বাইডুর মতো কোম্পানির জন্য সেই খরচ বাড়ানো কি অসম্ভব? মোটেও না।”

এআই গবেষকরা চ্যাটজিপিটির মতো সিস্টেমগুলোকে প্রস্তুত করতে হার্ডওয়্যারের আকার ছোট করে খরচ কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সফল হলে চিপের সংখ্যা কমে, চীনের ওপর দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধের প্রভাব অনেকটাই লাঘব হবে।

“দুই বছর আগে প্রযুক্তি জগতে সবাই ভেবেছেন, এআই এর হার্ডওয়্যারের আকার কেবল বড় হতেই থাকবে।” বলছিলেন এআই তৈরিতে সফটওয়্যার সহায়তাদাতা সানফ্রান্সিসকোভিত্তিক এনিস্কেলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কেড ড্যানিয়েল।

“সেই পরিস্থিতি এখনো থাকলে মার্কিন কড়াকড়ি চীনকে বেকায়দায় ফেলে দিতো।” ড্যানিয়েল আরো বলেন, “রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিটি চীনকে কিছুটা চাপে ফেলছে সত্যি, কিন্তু পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ হতে পারতো, সেটি হয়নি।”