তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত চার হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ খুন হয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনীর হাতে। তবে জাতিসংঘ বলছে, মৃত্যুর সংখ্যা ‘সম্ভবত এর চেয়ে অনেক বেশি’।
Published : 28 Aug 2023, 02:57 PM
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে গ্রেপ্তার হন ‘কো টুত’-এর বন্ধু ও তার গর্ভবতী স্ত্রী। এই ঘটনার পর টুত এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে নিজের আইটি দক্ষতা ব্যবহার করে দেশটির সামরিক শাসন ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যস্থির করেছেন তিনি।
ওই লক্ষ্যে টুত এমন এক মোবাইল গেইম বানিয়েছেন, যা মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া ‘সত্যিকারের ঘটনার’ ভিত্তিতে তৈরি। এরইমধ্যে সাফল্য দেখিয়েছে গেইমটি। আর দেশটির সামরিক জান্তার ওপর চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি সেনাবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় তহবিলও আসছে গেইমটি থেকে।
“তারা জীবনে কোনোদিন একটি অপরাধও করেনি।” – গণতন্ত্রকামী আন্দোলনে সমর্থনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া দম্পতি সম্পর্কে বলেন টুত।
পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে কী হয়েছে, তা জানেন না টুত। তবে বিবিসি নিশ্চিত করেছে, ওই গর্ভবতী নারীকে গ্রেপ্তারের একদিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হলেও তার স্বামী দেড় বছর ধরে কারাভোগ করছেন।
তাদের গ্রেপ্তারের পর টুত জানতে পারেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তার বন্ধুর স্ত্রীর পাশাপাশি অপর এক গণতন্ত্রকামী অধিকারকর্মীর কন্যাশিশুকেও গ্রেপ্তার করেছে, যার আর কোনোও খোঁজ মেলেনি।
“নোংরা, জঘন্য এক কারাগারের ভেতর বড় হতে একটি শিশুর কেমন লাগতে পারে, ভেবে দেখেছেন? আর আপনার ধারণাও নেই যে আশপাশে কী হচ্ছে। এসব ভেবেই আমার রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল।”
এর পরপরই মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আইটি কর্মী টুত। আর তার অস্ত্র নিজের তৈরি নতুন গেইম।
একটি এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে টেক্সট বার্তায় বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন টুত। তবে, নিজের অবস্থান প্রকাশ করেননি তিনি। আর তার নিরাপত্তার স্বার্থে এই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রায় পুরোদমে গৃহযুদ্ধ চলছে মিয়ানমারে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিকাল প্রিজনার্স’-এর তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত চার হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ খুন হয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনীর হাতে। তবে জাতিসংঘ বলছে, মৃত্যুর সংখ্যা ‘সম্ভবত এর চেয়ে অনেক বেশি’।
এদিকে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হতাহতের কথা স্বীকার করলেও কোনও সংখ্যা উল্লেখ করেনি। অন্যদিকে, প্রবাসী ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ বলছে, এর প্রতিরোধের ফলে ২০ হাজার সেনা মারা গেছে। তবে, সে সংখ্যাটি নিশ্চিত করতে পারেনি বিবিসি।
কো টুতের লক্ষ্য ছিল, ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)’ নামে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবিরোধী বাহিনীর জন্য অস্ত্র ও মানবিক তহবিল গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি, দেশটির চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো।
“আমার মনে হয়েছে, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে খুবই কম সহায়তা পাচ্ছি।” --ইউক্রেইন ও রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের চেয়ে মিয়ানমারের পরিস্থিতি তুলনামূলক কম সম্প্রচার পাচ্ছে, এমন দাবি করে বলেন তিনি।
‘আসল যুদ্ধে আসল মানুষ’
২০২২ সালের শুরুতে টুতের গেইমটি প্রকাশ পায় ‘দ্য পিডিএফ গেইম’ নামে।
গেইমটি বিনামূল্যেই ডাউনলোড করা যাবে। তবে আর্থিক তহবিল পাওয়ার অংশ হিসাবে গেইমারদের গেইমের মধ্যে থাকা বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে হয়। টুতের অনুমান বলছে, এখন পর্যন্ত গেইমটি থেকে পাঁচ লাখ আট হাজার ডলারের আর্থিক তহবিল উঠেছে।
টুতের দাবি, তিনি প্রতি মাসে গেইমটি থেকে ৭০-৮০ হাজার ডলার পাচ্ছেন আর এই সংখ্যা প্রতি মাসেই ‘বাড়ছে’।
গেইমের মধ্যে পিডিএফ সেনাদলের ভূমিকায় থাকা গেইমাররা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেন। আর বাস্তবে সেনাদলটি মিয়ানমারে যে ধরনের মিশন পরিচালনা করে, সেভাবেই কাজ করেন।
কো টুত বলেন, বাস্তবে যারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাদের ওপর ভিত্তি করে তিনি গেইমের বিভিন্ন চরিত্র তৈরি করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, মুসলিম ও এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্যরা।
তিনি আরও যোগ করেন, এগুলোর উল্লেখ জরুরী, কারণ, ‘তারা সত্যিকারের যুদ্ধ লড়ছেন’।
গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপল অ্যাপ স্টোর উভয় জায়গাতেই গেইমটি পাওয়া যাচ্ছে। তবে, কোম্পানিগুলোর ‘স্পর্শকাতর ঘটনা’ সংশ্লিষ্ট নীতিমালার কারণে গেইমটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন টুত।
গুগল প্লে স্টোরে গেইমটির নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘ওয়ার অফ হিরোস - দ্য পিডিএফ গেইম’। গুগল বলেছে, তারা এমন অ্যাপে অনুমোদন দেয় না, যা ‘কোনো স্পর্শকাতর ঘটনার সুযোগ নেয়’। তবে, ‘ব্যবহারকারীকে সতর্ক করার বা সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে’ তারা অনুমোদন দিয়ে থাকে।
এ ছাড়া, অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরেও গেইমটির নাম বদলে ‘ওয়ার অফ হিরোস (জিজেড)’ রাখা হয়। তবে, এর পরপরই প্ল্যাটফর্মটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় গেইমটি। একে ‘বড় এক ধাক্কা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন টুট।
অ্যাপল বলেছে, অ্যাপটি তাদের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তাদের যুক্তি হল, কোনো গেইম ‘কোনো দেশের সরকার বা অন্য কোনো সত্যিকারের স্বত্ত্বাকে এককভাবে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে না।’ আর এটি তাদের সহিংসতা বিষয়ক নীতিমালাও লঙ্ঘন করে।
তবে, টুত গেইমে কয়েকটি সংশোধন আনার পর গেইমটি পুনরায় অ্যাপ স্টোরে ফিরিয়ে এনেছে অ্যাপল। এর মধ্যে রয়েছে গেইমে তার মূল শিল্পকর্ম দেখানো ও কয়েকটি সামরিক মিশন সরিয়ে ফেলার মতো বিষয়াদি।
“এটা আসলেও খুবই ভাল সংবাদ। আর আমরা আশা করছি যে এখন আমাদের আর্থিক আয় আরও বেড়ে যাবে।” --বলেন তিনি।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে টুতের তৈরি গেইমটি। এপ্রিলে শাসকদলটি দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে নোটিশ জারি করে, ‘পিডিএফ গেইম খেলার’ জন্য দেশের নাগরিকরা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।