কোনো কিছু ‘ধরে রাখা’ বা তা থেকে ‘সরে আসা’ উচিৎ কি না, আমরা প্রায়শই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এমন দ্বিধার মধ্যে পড়ে থাকি, সেটা সম্পর্ক হোক কিংবা পেশাগত ক্যারিয়ার।
Published : 05 Dec 2024, 04:47 PM
কখনও কি মনে হয়েছে, আপনি এমন একটা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, যা কখনওই আসবে না?
এক্ষেত্রে প্রথম দিকে মানুষ কিছুটা আশাবাদী হলেও সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখনই মাথায় এমন ভাবনা চলে আসতে পারে যে, ‘আমার কি অপেক্ষা করা উচিৎ, না এর থেকে সরে আসাই শ্রেয়?’
কোনো কিছু ‘ধরে রাখা’ বা তা থেকে ‘সরে আসা’ উচিৎ কি না, আমরা প্রায়শই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এমন দ্বিধার মধ্যে পড়ে থাকি, সেটা সম্পর্ক হোক কিংবা পেশাগত ক্যারিয়ার।
মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে এমন জটিল সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিষয়ে গবেষণা করছেন ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া’র মনোবিদ জো কেবল।
কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে রাখা বা কখন সেখান থেকে বেরিয়ে পড়া উচিৎ, এর মধ্যে যে ভারসাম্য, তা খতিয়ে দেখেছে এ গবেষণাটি।
সম্প্রতি ‘জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্স’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কেবল ও তার গবেষণা দল একটি কয়েন সংগ্রহের গেইম থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন মানুষ কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোনো কিছু ধরে রাখা বা তা থেকে সরে আসা উচিৎ কি না।
এ গবেষণায় মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতির দিকে আলোকপাত করেছে গবেষণা দলটি, যা পরবর্তীতে গিয়ে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এমনকি আসক্তির মতো মানসিক রোগ নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে।
এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা একটি কয়েন সংগ্রহের গেইম খেলেছিলেন, যেখানে সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েনগুলোর দাম বাড়তে থাকে।
এর মধ্যে কিছু পরিস্থিতিতে সেরা কৌশল ছিল, কয়েনের দাম বেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আর অন্যান্য ক্ষেত্রে কয়েনের দাম বেড়েছিল অপ্রত্যাশিতভাবে, যেখানে হাল ছেড়ে দেওয়া স্মার্ট সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এদিকে, অংশগ্রহণকারীদেরকে খেলার নিয়ম না বলে দেওয়ার কারণে তাদেরকে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই শিখতে হয়েছিল।
এতে গবেষকরা স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের পাশাপাশি এমন ব্যক্তিদেরও গবেষণায় যোগ করেছেন, যাদের মস্তিষ্কের সামনের স্তরের সুনির্দিষ্ট এমন কিছু অংশে ক্ষত ছিল, যেগুলো মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ দুই শ্রেণির তুলনা করার পর তারা শনাক্ত করেছেন, কীভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ অধ্যবসায় ও প্রস্থান নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, মানব মস্তিষ্কের ‘ভেন্ট্রোমেডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (ভিএমপিএফসি)’ নামের অংশটি অংশগ্রহণকারীদের অপেক্ষা করার আগ্রহ কমিয়েছে, এমনকি যখন অধ্যাবসায় বা গেইমটি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও তুলনামূলক ভালো ছিল।
“অপেক্ষা করলে কোনো লাভ হবে কি না, মস্তিষ্কের এই অংশ সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে,” বলেছেন গবেষক ক্যামিলা ভ্যান গিন। পুরোপুরি কার্যকর ‘ভিএমপিএফসি’ বাদে মানুষকে অপেক্ষা করার মূল্য বুঝতে কাঠখড় পোড়াতে হয় বলে উঠে এসেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজের প্রতিবেদনে।
‘ডোরসোমিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (ডিএমপিএফসি) ও ‘অ্যান্টেরিয়র ইনসুলা (এআই)’র মতো মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে ক্ষত সৃষ্টি হলেও সমস্যা আছে। কারণ ভিএমপিএফসি’র ক্ষতওয়ালা মানুষদের মতো এরা এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে না দিলেও নতুন কৌশল অবলম্বনে তারা ব্যর্থ হয়।
এমনকি কোন অপেক্ষাটি যুক্তিসঙ্গত আর কোনটা নয়, এমন দুটি পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য করতেও এদের সমস্যা হয়।
রোমাঞ্চকর বিষয় হল, ডিএমপিএফসি’তে ক্ষত তৈরির প্রায়শই যোগসূত্র থাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে। তবে, এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় কোনো প্রভাব পড়ে না। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, অধ্যবসায় বা প্রস্থানের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির চেয়েও বেশি কিছু লাগে, তা হল, মস্তিষ্ককে অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করতে দেওয়া ও তা থেকে শিক্ষা নেওয়া।
প্রস্থান মানেই ব্যর্থতা নয়
কেবলের ব্যাখ্যা অনুসারে, অধ্যাবসায় ও প্রস্থান আসলে একই মুদ্রার দুটি পিঠ।
“আমরা প্রায়শই মনে করি, প্রস্থান করা মানে হাল ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু কখনও কখনও সেটাই স্মার্ট সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে,” যোগ করেন ভ্যান গিন। উভয়ক্ষেত্রেই জটিল মানসিক হিসাব নিকাশ করতে হয়, আর সঠিক সিদ্ধান্তটি নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।
গবেষণা দলটি এখন খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, মস্তিষ্কের বিভিন্ন রাসায়নিক যেমন ডোপামিন ও সেরোটনিন কীভাবে অধ্যাবসায় সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
এর প্রাথমিক ফলাফলে ইঙ্গিত মিলেছে, অপেক্ষা করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় সেরোটনিন হয়ত বড় ভূমিকা রাখে। আর এইসব প্রক্রিয়া চলার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন সিস্টেম কীভাবে সমন্বিত হয়ে কাজ করে, ভবিষ্যৎ গবেষণায় গবেষকরা সেটিও পরীক্ষা করবেন বলে উঠে এসেছে নোরিজের প্রতিবেদনে।
পরিশেষে বলা যায়, আমরা কীভাবে কোনো কিছু আঁকড়ে রাখার বা তা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, তা বুঝতে পারলে মানুষ জীবনে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এমনকি এ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থাও আগের চেয়ে উন্নত করার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।