এ নাটকীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অল্টম্যান বলেন, লোকজন এমন এআই প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
Published : 04 Jan 2024, 05:54 PM
২০২৩ সাল শুরুর আগেই লোকমুখে প্রচলিত নাম হয়ে ওঠার পর্যায়ে ছিল চ্যাটজিপিটি।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবটটি উন্মোচনের কয়েক সপ্তাহ পরই বিভিন্ন সূত্র রয়টার্সকে জানায়, ২০২৪ সালে চ্যাটবটটি দিয়ে একশ কোটি ডলার পর্যন্ত আয়ের আশা করে ওপেনএআই।
চ্যাটবটটির লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলে সহজ প্রম্পটের ভিত্তিতেই বিভিন্ন কবিতা, গান বা স্কুলের নিবন্ধ তৈরির সুবিধা থাকায় উন্মোচনের মাত্র দুই মাসেই ১০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক অর্জন করে চ্যাটজিপিটি। এ কৃতিত্ব অর্জনে ফেইসবুকের সময় লেগেছিল সাড়ে চার বছর। আর সবচেয়ে বর্ধনশীল গ্রাহক অ্যাপের তকমা পাওয়া টুইটারের লেগেছে পাঁচ বছর।
কখনও কখনও অতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নের ভুল জবাব দিতেও দেখা গেছে এ ধরনের চ্যাটবটগুলোকে। এআইয়ের ভুল তথ্য দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ‘হ্যালুসিনেট’ শব্দটিকে বছরের সেরা শব্দ বলে আখ্যা দিয়েছে ডিকশনারি ডটকম। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, সমাজের ওপর এ প্রযুক্তির প্রভাব কতটা গভীর।
তবে, এ ধরনের ভুল নতুন এ প্রযুক্তির উন্মাদনা বা সম্ভাব্য অস্তিত্ব ভীতিকে দমাতে পারেনি।
বাজার বিশ্লেষক কোম্পানি পিচবুকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওপেনএআইয়ের পক্ষে মাইক্রোসফটের শত শত কোটি ডলারের বাজি’সহ ২০২৩ সালে বিভিন্ন জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপ কোম্পানির পেছনে সর্বমোট দুই হাজার সাতশ কোটি ডলার ঢেলেছেন বিনিয়োগকারীরা।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানির মধ্যে পর্দার আড়ালে এআই খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার লড়াই চলছে, যা হঠাৎ করে নজরে আসে যখন অ্যালফাবেট, মেটা ও অ্যামাজন সকলেই নিজ নিজ মাইলফলকের ঘোষণা দিতে শুরু করে।
গত বছরের মার্চে ইলন মাস্ক’সহ হাজার হাজার বিজ্ঞানী ও এআই বিশেষজ্ঞ এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন, যেখানে মানবতার অস্তিত্বে হুমকিস্বরূপ বিভিন্ন শক্তিশালী এআই ব্যবস্থার সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে আরও বেশি গবেষণার দাবি করা হয়। আর তারা একে তুলনা করেছেন ক্রিস্টোফার নোলানের আলোচিত সিনেমা ‘ওপেনহাইমার’-এর সঙ্গে, যেখানে পারমাণবিক বোমা নির্মাতারা সতর্ক করেছিলেন, এ প্রযুক্তি বিকাশে মানব বিলুপ্তির ঝুঁকি আছে।
“এটা অস্তিত্বে হুমকি।” --বলেছেন ‘এআই গডফাদার’ জেফ্রি হিনটন, যিনি মে মাসে গুগলের মালিক কোম্পানি অ্যালফাবেট থেকে পদত্যাগ করেন।
“এটি মানুষের সক্ষমতার এতটাই কাছাকাছি যে আমাদের এখন থেকেই এ বিষয় নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করা উচিৎ। আর এ প্রযুক্তি নিয়ে কী করা যায়, তার উপায় খুঁজে দেখতে হবে। এর জন্য প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন।”
এটি গুরুত্বপূর্ণ কেন
পরামর্শক কোম্পানি ‘কনসালটেন্সি পিডব্লিউসি’ অনুমান করছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এআই সংশ্লিষ্ট খাতে আয় বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি, যা চীনের জিডিপি’র কাছাকাছি।
এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, এক সময় অর্থ, আইন, উৎপাদন ও বিনোদন প্রায় সকল খাতের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উপস্থিতি মিলবে এআই প্রযুক্তির।
এআই যুগের বিজয়ী ও অভাগাদের নাম এখনও কেবল শুরুর পর্যায়ে আছে। অন্যান্য যুগে অবশ্য সুবিধাভোগীদের জন্য একটি সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে লিখেছে রয়টার্স।
কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে এআই নিরপেক্ষ আচরণ করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন। এদিকে, বিভিন্ন লেবার ইউনিয়ন সতর্ক করেছে, এআই প্রযুক্তির উত্থানে মানুষের কর্মসংস্থানে গভীর ব্যাঘাত ঘটবে, যেখানে ঝুঁকিতে আছে কম্পিউটার কোড লেখা ও বিনোদনভিত্তিক কনটেন্টের খসড়া তৈরির মতো চাকরিগুলো।
বৈশ্বিক এআই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল এনভিডিয়ার গ্রাফিক্স প্রসেসর। অ্যাপল ও অ্যালফাবেটের পর ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাবে প্রবেশ করে এ খাতের প্রাথমিক বিজয়ী হিসেবে উঠে এসেছে মার্কিন চিপ নির্মাতা কোম্পানিটি।
গত বছরের শেষ মাসগুলোয় আরেকজন বিজয়ীর নাম প্রেক্ষাপটে এসেছিল। নভেম্বরে ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যানকে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, অল্টম্যান পর্ষদের সঙ্গে ‘যথেষ্ট স্বচ্ছ’ ছিলেন না।
তবে, অল্টম্যানকে ছাঁটাইয়ের পর কোম্পানির কর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ করার পাশাপাশি তাকে ছাঁটাইয়ের কারণ দর্শাতে বলেন পর্ষদকে। এমনকি এক খোলা চিঠিতে গণস্বাক্ষর করে কোম্পানি ছেড়ে অল্টম্যানের দলে যোগ দেওয়ার হুমকিও দেন তারা।
একদিকে, অল্টম্যান এআই প্রযুক্তি বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আর অন্যদিকে, এ প্রযুক্তি নিয়ে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন সংশয়বাদীরা।
পর্ষদের সঙ্গে যুদ্ধে অবশ্য অল্টম্যান জিতেছেন। ফলে, ছাঁটাইয়ের চার দিন পরই কোম্পানিতে পুনরায় নিজ পদে ফিরে আসেন তিনি।
এ নাটকীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অল্টম্যান বলেন, লোকজন এমন এআই প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
“আমার মনে হয়, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল।” --ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্কে এক আয়োজনে বলেন অল্টম্যান।
অল্টম্যানের ছাঁটাইয়ের আগে কয়েকজন ওপেনএআই গবেষক ‘কিউস্টার’ নামে পরিচিত কোম্পানির নতুন গোপন এআই মডেল নিয়ে সতর্ক করেছিলেন বলে নভেম্বরে উঠে আসে রয়টার্সের প্রতিবেদনে।
২০২৪ সালে এর গুরুত্ব কতোটা?
ওপেনএআইয়ের নাটকীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তা হল, ভবিষ্যতে এআই প্রযুক্তির সামাজিক প্রভাব কী সিলিকন ভ্যালি’র বন্ধ দরজায় থাকা সুবিধাভোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে কি না।
২০২৪ সালে এ প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের লক্ষ্য নিয়েছে ইইউ’র বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যেখানে ‘এআই অ্যাক্ট’-এর রূপে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হবে। আসন্ন সপ্তাহগুলোয় আইনটির খসড়া প্রকাশ করা হবে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে রয়টার্স।
এ ধরনের বেশ কিছু নিয়মের খসড়া তৈরি হচ্ছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। তাও এমন এক বছরে, যখন বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর এতে ভোটারদের লক্ষ্য করে এআইয়ের মাধ্যমে ভুল তথ্য বানানোর ঝুঁকিও বাড়ছে।
এদিকে, ২০২৩ সালে বিভিন্ন সংবাদের মান নির্ধারনের লক্ষ্যে রেটিং সিস্টেম চালু করেছে সংবাদ সাইট নিউজগার্ড।