‘সভ্যতা বিলুপ্তির বীজ’ সামাজিক মাধ্যমে: জেরন লেনিয়ার

‘ওয়েব মতাদর্শ’ আর সেবাগ্রাহকদের ‘হাইভ মাইন্ড’-এর সংমিশ্রণ ‘সামাজিক বিপর্যয়’ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি শব্দগুচ্ছের প্রবর্তকের।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2022, 09:25 AM
Updated : 28 Nov 2022, 09:25 AM

সোশাল মিডিয়া প্রযুক্তিতে মানবসভ্যতা ‘বিলুপ্তির হুমকি’ দেখছেন ‘ভার্চুয়াল রিয়ালিটি’ শব্দগুচ্ছের প্রবর্তক এবং এই প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেরন লেনিয়ার।

ইন্টারনেট প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা এবং সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর মার্ক জাকারবার্গ ও ইলন মাস্কের মত প্রযুক্তি সেনাপতিদের একচ্ছত্র আধিপত্য মানব সমাজের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলছে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা এবং সামাজিক মাধ্যম প্রযুক্তির সমালোচক হিসেবে আগে থেকে সুপরিচিতি আছে লেনিয়ারের। একাধারে কম্পিউটার বিজ্ঞানী, কম্পোজার, ভিজুয়াল আর্টিস্ট, কম্পিউটার দর্শনের লেখক তিনি। ৮০’র দশকে প্রযুক্তি দুনিয়ায় ভার্চুয়াল রিয়ালিটি প্রযুক্তির অভিষেকও হয়েছিল তার হাত ধরেই।

পেশাজীবনের বিভিন্ন সময়ে গেইমিং কনসোল নির্মাতা আতারি থেকে শুরু করে গবেষক ও প্রকৌশলীদের জোট ‘ইন্টারনেট ২ কনসোর্টিয়াম’ এবং প্রথমসারির একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে কাজ করছেন টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফটের গবেষণা দলের সঙ্গে।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম টুইটার নিয়ে সাম্প্রতিক ‘উন্মাদনার’ প্রসঙ্গ টেনে অনলাইনের ‘সাইকোলজিকাল এজেন্ট’দের থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সামাজিক মাধ্যম প্রযুক্তির ওপর বর্তমান সমাজের অতিনির্ভরশীলতা নিয়ে লেনিয়ারের শঙ্কা পুরোনো। গত কয়েক মাসে টুইটার নিয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা আর সর্বপরি ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভুয়া তথ্যের প্রচার ক্রমাগত বৃদ্ধি সার্বিক পরিস্থিতির অবনতির দিকে নজর টানছে বলে মত তার। বর্তমান প্রযুক্তি শিল্পে শঙ্কিত হওয়ার জন্য বিপজ্জনক বিষয়ের অভাব নেই এবং সেগুলো মানবসভ্যতার জন্য বিলুপ্তির হুমকি বলে গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন তিনি।

“মানুষ টিকে আছে একে অন্যের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করে। মানবতার সেই মৌলিক গুণটিকে আমরা এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি যেখানে দুর্নীতি আর অবক্ষয় পুরস্কৃত। এ সময়ের মৌলিক নাটকীয়তার বিষয়বস্তু হচ্ছে আমরা এই উপাদানগুলো নিয়েই সঠিকভাবে বাঁচতে পারবো কি না।”

ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি আর ফেইসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের মুনাফার লোভে সেবাগ্রাহকের মানসিক সুস্থতা অগ্রাহ্য করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে আগে থেকেই। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইলন মাস্কের টুইটারে ‘জুড়ে বসা’র সফল অপচেষ্টার ওপর বাড়তি গুরুত্বারোপ নতুন মাত্রা যোগ করেছে সে শঙ্কায়।

এ ছাড়াও ইন্টারনেটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে সক্রিয় মনস্তাত্ত্বিক এজেন্টদের নিয়েও সতর্ক করে দিয়েছেন লেনিয়ার।

আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদের সমন্বয় করতে পারি তবে সেটা হবে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত যে আমরা (সমাজ হিসেবে) এখনও পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়িনি।

এরা প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য তথ্য-উপাত্ত সম্পাদনা এবং প্রচারণার কাজ করছে। অল্প কথায় বললে, শুরুর দিনগুলোতে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা তথ্যের মুক্তাঙ্গন হিসেবে যে ইন্টারনেট ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন, বর্তমান বাস্তবতা তার পুরোপুরি উল্টো। লেনিয়ারের মতে, পুরো ব্যবস্থাটি নীতিগত জায়গা থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ক্রমাগত এর অপব্যবহার চলছে।

“এখানে নানা রকমের মধ্যস্বত্ত্বভোগী আছে। প্ল্যাটফর্মের মালিকানা যাদের হাতে তারাও হতে পারেন, সাম্প্রতিক সময়ের ইলন মাস্ক বা এমন কোনো তৃতীয় পক্ষ যারা মানুষকে প্রভাবিত করতে সিদ্ধহস্ত। মাঝে নাক গলানোর মানুষগুলো নানা রকমের হতে পারে। কেউ সরকারি কর্মকর্তা, কেউ জনসমক্ষেই কাজ করেন, কেউ বা লুকিয়ে। এদের কেউ কেউ নিজের কাজে যোগ্য, কেউ একেবারেই অযোগ্য – বিষয়টা এমন যে, একজন এমন একটা অ্যালগরিদম বানিয়েছেন যা তিনি নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না।”

এ পরিস্থিতির ঝুঁকি কোনো বিবেচনাতেই কম নয়। “আমি এখনও মনে করি অন্তিম ফলাফল হিসেবে (মানবসভত্যার) বিলুপ্তিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদের সমন্বয় করতে পারি তবে সেটা হবে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত যে আমরা (সমাজ হিসেবে) এখনও পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়িনি” গার্ডিয়ানকে বলেছেন লেনিয়ার।

পেশাজীবনের পুরোটা জুড়েই কম্পিউটার কোডের এক আর শূন্যের বাইরের দুনিয়ার দিকে নজর রেখেছেন আজকের ৬২ বছর বয়সী লেনিয়ার। আধুনিক ওয়েব ২.০ মান নির্মাণে অংশ নিয়েছিলেন তিনি; ‘ডিজিটাল ইউটোপিয়া’ ভাবনা ছিল তার কর্মজীবনের কেন্দ্রে।

কিন্তু, বর্তমান দৃশ্যপটে সেই ‘ডিজিটাল ইউটোপিয়া’ নিয়ে আগের মতো আশাবাদী নন লেনিয়ার। বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল ইউটোপিয়ার বদলে ‘ডিজিটাল মাওইজম’ বিরাজ করছে বলে মনে করেন এ কম্পিউটার বিজ্ঞানী। লেনিয়ারের চোখে ফেইসবুক আর গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর ভূমিকা কল্পবিজ্ঞান গল্পের ‘স্পাই এজেন্সি’র মতো।

আর সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর অতিনির্ভরশীলতা নিয়ে প্রথম থেকেই কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন লেনিয়ার। তার ভাষায়, ‘বিড়াল নিয়ে আদুরে ভিডিও আর গৃহযুদ্ধ’, এখানে দুটোই পাবেন আপনি।

২০১০ সালে প্রকাশিত ‘ইউ আর নট এ গ্যাজেট: এ ম্যানিফেস্টো’ বইয়ে ওয়েব মতাদর্শ নিয়ে এবং সেবাগ্রাহকদের ‘হাইভ মাইন্ড’ নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন লেনিয়ার; এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ‘সামাজিক বিপর্যয়’ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কার কথা বলেছিলেন বইয়ে।

স্বীকৃতি, অস্বীকৃতি, উপেক্ষার মতো কৌশলগুলোর কলকাঠি নেড়ে মানুষের মধ্যে আসক্তি বপন করা হচ্ছে, যা পুরো সমাজকেই প্রভাবিত করছে এবং যার বর্ণনা দিতে গালভরা ‘এনগেজমেন্ট’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লেনিয়ারের শঙ্কায় নতুন মাত্রা যোগ করছে ১৯৩৭ সালে হার্ভার্ড মনস্তত্ববিদ বিএফ স্কিনারের প্রস্তাবিত ‘অপারেন্ট কন্ডিশনিং’ তত্ত্ব। এ তত্ত্বে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় পরিণতির ভাবনা থেকে; ‘বিহেভিয়ার মডিফিকেশন’ নামেও পরিচিতি আছে এ তত্ত্বের।

নিজের গবেষণায় ইঁদুরের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনতে বৈদ্যুতিক শক আর পুরস্কারের ব্যবহার করেছিলেন স্কিনার। সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতেও ব্যবহারকারীদের একই ধরনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে বলে মনে করেন লেনিয়ার।

“আমি বিশ্বাস করি আমি এমন সব মানুষ দেখছি যারা অনলাইনে অপারেন্ট কন্ডিশনিংয়ের শিকার হচ্ছেন, অর্থাৎ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই হচ্ছে মানুষের।”

স্বীকৃতি, অস্বীকৃতি, উপেক্ষার মতো কৌশলগুলোর কলকাঠি নেড়ে মানুষের মধ্যে আসক্তি বপন করা হচ্ছে যা পুরো সমাজকেই প্রভাবিত করছে এবং যার বর্ণনা দিতে গালভরা ‘এনগেজমেন্ট’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র ব্যাখ্যা করে লেনিয়ার গার্ডিয়ানকে বলেন, “আমরা এমন একটা যুগে প্রবেশ করছি যেখানে আসলে কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই; সবকিছুই ক্ষমতা, মধ্যস্থতা এবং প্রভাব বিস্তারকেন্দ্রীক। নতুন কোনো ভাবনার প্রচার যেমন কঠিন, তেমনি ভুল উপস্থাপনাও খুবই সহজ।”

আমি কখনোই দাবি করি না যে আমার কাছে সব জবাব আছে; তবে আমি এটা সত্যিই বিশ্বাস করি যে- আমাদের টিকে থাকার বিষয়টি ইন্টারনেট সংস্কারের ওপর নির্ভর করছে।

প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে লেনিয়ার লিখেছেন, ‘টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করেন এমন মানুষদের জনসমক্ষে আচরণে’ পরিবর্তন চোখে পড়েছে তার।’ সরাসরি ইলন মাস্ক, ডনাল্ড ট্রাম্প এবং কানিয়ে ওয়েস্টের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি।

এক সময় জনসাধারণের কাছে সমাদৃত হলেও এদের প্রত্যেকেই জন জীবনে ‘অপ্রাপ্তবয়স্কদের মতো’ আচরণ শুরু করেছেন বলে মনে করেন তিনি। এ পরিস্থিতি ‘অপারেন্ট কন্ডিশনিং’ প্রক্রিয়ারই ফলাফল বলে মনে করেন লেনিয়ার; একে ‘টুইটার পয়জনিং’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেনিয়ার লিখেছিলেন, “আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, এই মানুষগুলোর আচরণ একই রকমের ব্যক্তিত্বে পরিবর্তিত হচ্ছে যা আগে ছিল না। এর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যম আসক্তির সম্পর্ক আছে, অথবা টুইটার পয়জনিং?”

বিভিন্ন সময় নিজেকে ‘শঙ্কিত আশাবাদী’ বলে পরিচয় দিয়েছেন লেনিয়ার। তবে এ প্রযুক্তি গবেষকের মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে বলে মন্তব্য করেছে গার্ডিয়ান।

“ইতিহাসের পুরোটা জুড়েই মানুষ নানা নেতিবাচক কাজ করেছে, তাই বিদ্যমান অকার্যকর পরিস্থিতির মধ্যে কার্যকারণ নির্ভর যোগসূত্র টানা বেশ কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মতো মানসিক সুস্থতা ধরে রেখে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের কাজ করতে পারবো কি না।”

“আমরা একটা বাজে মানুষে পরিণত হই কি না তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি; কারণ, দিন শেষে বাজে মানুষরাও টিকে যেতে পারে। কিন্তু সরাসরি যোগাযোগের সক্ষমতা নেই এমন মানুষরা পারবেন না।”

“এমনকি যারা সহযোগিতা করতে চান তারাও হয়তো সাহায্য করতে পারবেন না, কারণ, তারা এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছেন যেখানে তাদের প্রত্যাশা মতো তাদের কথায় কেউ কান দিচ্ছেন না। এখন আমাদের সে আত্মবিশ্বাসই নেই যে, আমরা যা বলছি তা কেউ সঠিকভাবে শুনবেন,” গার্ডিয়ানকে বলেছেন লেনিয়ার।

তবে, এতো শঙ্কার মধ্যেও লেনিয়ারের আশা– তিনি ভুল প্রমাণিত হবেন।

“আপনি যদি নৈরাশ্যবাদী ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং সেটা সত্যি হয় তবে তার মানে হচ্ছে আপনি নিজে কোনো কাজেই আসেননি। আমি কখনোই দাবি করি না যে আমার কাছে সব জবাব আছে; তবে আমি এটা সত্যিই বিশ্বাস করি যে- আমাদের টিকে থাকার বিষয়টি ইন্টারনেট সংস্কারের ওপর নির্ভর করছে – এমন একটা কাঠামো তৈরি করতে হবে যা মানুষের চেতনার জন্য বন্ধুসুলভ এবং মানুষ সত্যিই যেমন তার প্রতিফলন হয়।”