‘উইগনার ক্রিস্টাল’-এর ধারণাটি এসেছে ‘প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি’র পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইউজিন উইগনারের কাছ থেকে।
Published : 17 Apr 2024, 05:27 PM
সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় ইলেক্ট্রন স্ফটিকের রহস্য উন্মোচন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
ইলেকট্রন হচ্ছে সেই ক্ষুদ্র কণা, যা পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াসের চারপাশে সবসময় ঘুরপাক খায়, যেখানে এক শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে এটি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে ইলেকট্রন এখনও বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, যা যে কোনো সময় নতুন কোনো বৈশিষ্ট্যের জানান দিয়ে সবাইকে অবাক করতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানবিষয়ক সাইট নোরিজ।
সম্প্রতি ইলেকট্রন সম্পর্কে অবাক করা নতুন ধারণা প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি’র একদল পদার্থবিদ, যেখানে তারা প্রথমবারের মতো ‘উইগনার ক্রিস্টালে’র দিকে সরাসরি নজর দিয়েছেন। বিশেষ এ পদার্থটি পুরোপুরি ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি।
উইগনার ক্রিস্টাল হল ইলেক্ট্রনের কঠিন বা স্ফটিক পর্যায়।
বিজ্ঞান ভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত এ গবেষণাটি পুরোনো এক তত্ত্বকে আরও পাকাপোক্ত করেছে, যা প্রায় ৯০ বছর ধরে প্রচলিত। সে তত্ত্ব অনুসারে, ইলেকট্রন নিজেই মুক্তভাবে থাকতে পারে, এদের কোনও পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রয়োজন নেই। আর ইলেকট্রনের এই ‘মুক্ত’ চেহারা হচ্ছে ইলেকট্রনের স্ফটিক বা ক্রিস্টাল।
গবেষণাটির মাধ্যমে নতুন ধরনের পদার্থ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ইলেকট্রনের একত্রে কাজ করার বিষয়টিও জড়িয়ে আছে।
‘উইগনার ক্রিস্টাল’-এর ধারণাটি এসেছে ‘প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি’র পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইউজিন উইগনারের কাছ থেকে।
১৯৩০’র দশকে একটি যুগান্তকারী ধারণা দিয়েছিলেন উইগনার, যেখানে বিভিন্ন ইলেকট্রন নিজস্ব গতানুগতিক গতিবিধির মাধ্যমেই নিজেদেরকে একত্রে সাজাতে পারে, বিশেষ করে ঠাণ্ডা পরিবেশে, যখন এরা একে অপরের কাছাকাছি লেগে থাকে না।
‘প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি’র নেতৃস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞানী আল ইয়াজদানি বলেছেন, “যখন আমরা স্ফটিকের কথা ভাবি, তখন আমরা সাধারণত বিভিন্ন পরমাণুর সমন্বিত অবস্থা কল্পনা করি, কারণ এরা একে অপরকে আকর্ষণ করে।”
তবে, ‘উইগনার ক্রিস্টাল’ একেবারে আলাদা, কারণ এটা শুধু ইলেকট্রনের বিকর্ষণ বা এদের মধ্যে ধাক্কার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে থাকে।
এ পরিস্থিতি এড়াতে গবেষণা দলটি গ্রাফিনের খুব স্পষ্ট নমুনা ব্যবহার করেছিল। গ্রাফিন মূলত ২১ শতকে আবিষ্কৃত কার্বনের একটি রূপ, যা কোয়ান্টাম পরীক্ষার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিতি পেয়েছে।
গবেষকরা গ্রাফিনকে ‘অ্যাবসলিউট জিরো বা পরম শূন্য’ তাপমাত্রার কাছাকাছি এনে ঠাণ্ডা করেন ও এতে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করেন, যা তাদেরকে ইলেকট্রনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ ও এরা কীভাবে আচরণ করে, তা পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করেছে।
গবেষকরা দেখতে পান, ইলেকট্রনের ঘনত্ব বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সেগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ধাক্কা দিতে শুরু করে ও স্ফটিকের মতো একটি গঠন তৈরি করে। এর পরও এর ঘনত্ব বাড়ালে এটি স্ফটিক থেকে তরল হয়ে যায়।
এ গবেষণাটি প্রথমবারের মতো ‘উইগনার ক্রিস্টালের’ সরাসরি ছবি দেখিয়েছে, যাকে এর অস্তিত্বের প্রমাণও ধরা যায়। ছবিগুলোতে দেখা গেছে, স্ফটিকটি ত্রিভুজাকার ছিল ও বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল ছিল এটি, যা এর স্থিতিশীলতা নিয়ে আগের বিভিন্ন অনুমানকেও চ্যালেঞ্জ করেছে।
এ ছাড়া, স্ফটিকের কয়েকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেছে গবেষণাটি। উদাহরণ হিসেবে, ছবিগুলোতে ইলেকট্রনগুলো কিছুটা ঝাপসা দেখাচ্ছিল। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, এগুলো শুধু এক জায়গায় আটকে ছিল না, বরং ছোট এক এলাকার মধ্যেও চলাচল করছিল।
ইলেকট্রনের এমন চলাচল আসলে ‘কোয়ান্টাম ইফেক্ট’ নামে পরিচিত। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, কঠিন স্ফটিক আকারে থাকলেও ইলেক্ট্রনগুলো এদের কিছু তরঙ্গায়িত ও অনিশ্চিত প্রকৃতি ধরে রাখতে পারে।
এ যুগান্তকারী অগ্রগতি শুধু একটি দীর্ঘস্থায়ী তত্ত্বকেই নিশ্চিত করে না, বরং পদার্থের অন্যান্য রহস্য অন্বেষণের নতুন পথও খুলে দেয়, যেখানে ইলেকট্রন বিরল ও সমন্বিত উপায়ে আচরণ করে।