Published : 20 Nov 2024, 07:11 PM
পানি কমে গিয়েছিল ভূমধ্যসাগরের। সেটা এত মারাত্মক হয়ে গিয়েছিল যে, পানি নেমে এসেছিল এক তৃতীয়াংশে। কিন্তু কেন?
গবেষকরা বলছেন, ওই ঘটনা ঘটেছিল ৫৫ লাখ বছর আগে। ৭০ শতাংশ পানি কমে গিয়েছিল সে সময়।
ওই সময় ভূমধ্যসাগরের বেশিরভাগ অংশকে এক বিশাল লবণের বেসিনে পরিণত করে ‘মেসিনিয়ান সলিনিটি ক্রাইসিস’ বা মেসিনিয়ান যুগের লবণাক্ততা সংকট নামে পরিচিত এক নাটকীয় ঘটনা। ফলে ছয় লাখ ৪০ হাজার বছর ধরে নিজের প্রায় ৭০ শতাংশ পানি হারায় সাগরটি।
এ বিস্ময়কর ঘটনাটিকে এখন আরও ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। ঘটনাটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিবেশ, ভূদৃশ্য ও বৈশ্বিক জলবায়ুর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
‘জিব্রাল্টার প্রণালী’র মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূমধ্যসাগর। ‘জিব্রাল্টার প্রণালী’ হচ্ছে পূর্বে ভূমধ্যসাগর ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগকারী সমুদ্র প্রণালী।
লাখ লাখ বছর আগে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আসা পানির প্রবাহকে জিব্রাল্টার প্রণালীর মধ্যদিয়ে ভূমধ্যসাগরে আসতে বাধা দিয়েছে টেকটোনিক প্লেটের স্থানান্তর ও ভূমির বাড়তি উচ্চতা।
ভূমধ্যসাগরে নতুন করে পানির প্রবাহও তৈরি হতে পারেনি বাষ্পীভবনের কারণে। ফলে নাটকীয়ভাবে আকারে ছোট ও অনেক লবণাক্ত হয়ে পড়ে সাগরটি।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’-এ।
কীভাবে এই প্রক্রিয়াটি ঘটেছে তা জানার জন্য গবেষণায় ভূমধ্যসাগরের তলদেশে থাকা লবণের ক্লোরিন আইসোটোপ বিশ্লেষণের উপর নজর দিয়েছেন গবেষকরা। এতে উঠে এসেছে, দুটি স্বতন্ত্র পর্যায়।
পর্যায় ১: পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অংশে লবণের প্রভাব
প্রথম পর্যায়টি চলেছে প্রায় ৩৫ হাজার বছর ধরে। এ পর্যায়ে প্রভাব পড়েছে ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের অংশে।
ওই সময় ভূমধ্যসাগরে, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আসা পানির প্রবাহ অনেক কমে আসে। কম পানির চলাচলের কারণে সাগরের পূর্ব অববাহিকা নোনা পানিতে ভরে ওঠে ও সেখানে অস্বাভাবিক হারে জমতে শুরু করে লবণ।
পর্যায় ২: ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমে যাওয়া
দ্বিতীয় পর্যায়টি ঘটে অনেক দ্রুত, যেখানে গোটা ভূমধ্যসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লবণ।
১০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পানির স্তর প্রায় ১.৭ থেকে ২.১ কিলোমিটার ও পশ্চিম অববাহিকায় পানির স্তর নেমে আসে প্রায় ০.৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত।
আর এ কারণেই ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পানি কমে যায় ভূমধ্যসাগরের।
পানির স্তর কমে যাওয়ার বিষয়টি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এই পানির প্রবাহ পৃথিবীর ভূত্বকের পরিবর্তন ঘটায়। ফলে স্থানীয় আগ্নেয়গিরিতে ঘটে অগ্ন্যুৎপাত।
ভূমধ্যসাগরের পানির স্তর নেমে আসার ফলে কমে যায় এর আকারও। আর এই বিশাল ক্ষতির প্রভাব গিয়ে পড়ে বৈশ্বিক জলবায়ুর ওপর, যা পরিবর্তন ঘটায় ভূমধ্যসাগরের আশপাশের চেহারায়। একসময় সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ভরা এই সাগর বদলে যায় অনুর্বর ও লবণাক্ত মরুভূমিতে।
কীভাবে ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন ঘটনা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছে এই মেসিনিয়ান লবণাক্ততা সংকটের ঘটনাটি।
ভূমধ্যসাগরের ইতিহাস ও ভবিষ্যতে কীভাবে এ ধরনের ঘটনা বৈশ্বিক জলবায়ু ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে তা আরও ভালভাবে বুঝতে বিজ্ঞানীদের সহায়তা করেছে এ গবেষণা।
জিব্রাল্টার প্রণালী আবার খুলে গেলে ভূমধ্যসাগর নিজের প্রাণ ফিরে পায়। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আবার পানি আসতে শুরু করে ভূমধ্যসাগরে। এই গুরুত্বপূর্ণ ‘রিফিলিং’ চিহ্নিত করেছে পৃথিবীর অন্যতম ভূতাত্ত্বিক ঘটনার সমাপ্তিকে।