মেসিময় ম্যাচে ‘নায়ক’ মার্তিনেসও

আর্জেন্টিনাকে জেতানোর জন্য যা যা করণীয় ছিল, সবটা করেও শেষ পর্যন্ত লিওনেল মেসি যেন নায়ক নন!

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2022, 05:33 AM
Updated : 10 Dec 2022, 05:33 AM

এক ম্যাচের নায়ক ভূমিকায় এত বদল! নাহুয়েল মোলিনাকে দিয়ে গোল করানোর পর ব্যবধান দ্বিগুণ করলেন লিওনেল মেসি। হিসেবটা এখানে চুকেবুকে গেলে ‘এককভাবে’ আর্জেন্টিনার জয়ের নায়ক হতে পারতেন বাঁ পায়ের জাদুকর। দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে হঠাৎ উদয় ভঠ ভেহর্স্টের। জোড়া গোলে নেদারল্যান্ডসের জয়ের সম্ভাবনা জোরালো করা এই ফরোয়ার্ডও হতে পারতেন নায়ক, কিন্তু হতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গড়ানো ম্যাচে দুটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনার নায়ক বনে গেলেন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস। অবশ্য এককভাবে কিনা, সে তর্ক হতেই পারে।

লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডের মধ্যেকার দ্বিতীয় কোয়ার্টার-ফাইনালে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের স্কোরলাইন ২-২। এরপর টাইব্রেকারে ৪-৩ ব্যবধানের জয়ে সেমি-ফাইনালে ঠাঁই করে নিয়েছে আলবিসেলেস্তারা। ১৯৮৬ সালের পর তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় থেকে মাত্র দুই সিঁড়ি দূরে তারা। অন্যদিকে আবারও ডাচদের সঙ্গী হলো একরাশ হতাশা।

প্রথমার্ধে যে নেদারল্যান্ডস আশার প্রদীপ জ্বালতে পেরেছিল, তা নয়। তবে মেসিকে বোতলবন্দী করে রাখার কাজটি শুরু থেকে দারুণভাবে করতে পারে তারা। কখনও ভার্জিল ফন ডাইক ও নাথান আকে, কখনও পাহারাদার আরও বাড়িয়ে আর্জেন্টিনা অধিনায়ককে কষে বেঁধে রাখে তারা। কিন্তু মেসি যে জাদুকর, তাই একটু ফাঁকফোকর পেয়ে ৩৫তম মিনিটে বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে আসেন, মোলিনাকে দিয়ে গোল করান, গ্যালারিতে আসা সমর্থকদের আনন্দে ভাসান।

ডান দিক দিয়ে আক্রমণে উঠে একটু আড়াআড়ি বাঁ দিকে গিয়ে রক্ষণচেরা পাস বাড়ান মেসি। ডি-বক্সের মুখে প্রথম ছোঁয়ায় বল ভেতরে টেনে দ্বিতীয় টোকায় আগুয়ান গোলরক্ষককে ফাঁকি দেন মোলিনা। জয়ের ক্যানভাসে প্রথম আচঁড়টি দেয় আর্জেন্টিনা।

দ্বিতীয়ার্ধেও যথারীতি মেসির চারপাশে দেয়াল। ৬২তম মিনিটে একটু বেরুতে গিয়েছিলেন, ওমনি ফন ডাইকের ধাক্কা। ফ্রি কিকের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি মেসি; বল উড়ে যায় ক্রসবারের উপর দিয়ে। অধিনায়ককে গোলের আনন্দে ডানা মেলার সুযোগ করে দেন মার্কোস আকুনিয়া। ৭৩তম মিনিটে তাকে ডাচ ডিফেন্ডার ডেনজেল ডামফ্রিস ফাউল করলে পেনাল্টিটি পায় আর্জেন্টিনা। গোলরক্ষককে প্রতিরোধের একবিন্দু সুযোগ না দিয়ে জাল খুঁজে নেন মেসি।

এ গোলেই রেকর্ড বই আর পরিসংখ্যানের পাতায় আঁকিবুকির হিড়িক পড়ে যায়। বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে (১০টি) ছুঁয়ে ফেলেন তিনি। আগে থেকে ৩৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা, সে সংখ্যা উন্নিত হলো ৯৫টিতে। কাতার বিশ্বকাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর চেয়ে গোল হলো ৩টি বেশি। মরুর আসরে এ পর্যন্ত খেলা পাঁচ ম্যাচে মেসির গোল ৪টি, রোনালদো আটকে আছেন সেই ঘানা ম্যাচে পাওয়া এক গোলে। সব বিশ্বকাপ মিলিয়ে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ডের (৮টি) চেয়ে তার গোল এখন ২টি বেশি।

৮৩তম মিনিট পর্যন্ত ম্যাচের চিত্রনাট্য চলছিল মেসিকে নাম ভূমিকায় রেখে। দুর্দান্ত হেডে ভেহর্স্ট নেদারল্যান্ডসকে ম্যাচে ফেরানোর উপলক্ষ্য এনে দিলেন বটে, কিন্তু তখনও মেসি নায়ক। বেসিকতাসের এই ফরোয়ার্ডই দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে, ঠিক শেষের বাঁশি বাজার আগ মুহূর্তে সুযোগসন্ধানী শটে সমতায় ফেরালেন নেদারল্যান্ডসকে। বিস্ময়ে বিমুঢ় মেসির আর্জেন্টিনা। লুসাইলের গ্যালারিতে আসা হাজারো আর্জেন্টিনা সমর্থক আচমকা আঘাতে হতভম্ব। ভেহর্স্টের সামনেও উঁকি দেয় নায়ক হওয়ার সুযোগ।

হঠাৎ যেন উঁকি দেয় প্রথম কোয়ার্টার-ফাইনালের ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটিও। এগিয়ে যাওয়া নেইমারের গোলটি আগলে রাখতে পারেনি সেলেসাওরা। সমতায় ফিরে শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য টাইব্রেকারে নিয়ে যায় ক্রোয়াটরা। সেখানে দমিনিক লিভাকভিচের দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ে রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের স্বপ্ন। টাইব্রেকারে হেরে বিদায় ঘণ্টা বাজে তিতের দলের।

এদিকে দুইবার পরাস্ত হওয়া ছাড়া আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস আহামরি কিছু করেননি ম্যাচে। বিপরীতে অ্যান্ড্রিস নোপার্ট মেসি-মার্তিনেসদের কয়েকটি আক্রমণ সামলেছেন। মার্তিনেসের চেয়ে তিন লম্বাও তিন ইঞ্চি বেশি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার্তিনেসই করেছেন বাজিমাত।

নিজের ডান দিকে ঝাঁপিয়ে ফন ডাইকের শট আটকে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নিলেন এক সিঁড়ি। অধিনায়ক মেসি প্রথম শটে লক্ষ্যভেদ করে প্রাণসঞ্চার করলেন সমর্থকদের মনে। এবার বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে স্টিভেন বেরহাসের পেনাল্টি রুখলেন মার্তিনেস। ডাচদের তখন হাসঁফাস করার অবস্থা। ‘ভামোস আর্জেন্টিনা, ভামোস আর্জেন্টিনা’ স্লোগানো তখন গুমগুম করছে গ্যালারি।

পরের তিন শটে গোল পেল নেদারল্যান্ডস, আর্জেন্টিনার এনসো ফের্নান্দেসও লক্ষ্যভ্রষ্ট শটে কিছুটা শঙ্কা বাড়ালেন বটে, কিন্তু লাউতারো মার্তিনেসের শেষ শট টেনে দেয় সব অনিশ্চয়তা ইতি। রোমাঞ্চ, টানাপোড়েনের নানা বাঁক পেরিয়ে সেমি-ফাইনালে ওঠার বাঁধহারা উচ্ছ্বাসে মাতে আর্জেন্টিনা। শুধু মেসিকে ঘিরে নয়, এমিলিয়ানো মার্তিনেস, লাউতারো মার্তিনেসও সে উৎসবের কেন্দ্রে থাকেন প্রবলভাবে।