কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সের খেলা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে মরক্কো উঠে আসবে, কেই বা ভেবেছিল! একের পর এক চমক দেখানো আর অঘটনের জন্ম দেওয়া আফ্রিকার দলটি কি পারবে আরও একবার ফুটবল বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিতে, বিস্ময়ে ভাসাতে? সময়েই তার উত্তর মিলবে। আপাত হিসেব, শক্তিমত্তা ও অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকায় ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামবে ফরাসিরা।
তবে ‘জায়ান্ট কিলার’ মরক্কানরা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে যে, তাদের সামর্থ্য আছে আরেকটি শক্তিশালী দলকে বিদায় করে দেওয়ার। আর তা করতে হলে সবার আগে মনোযোগী হতে হবে এমবাপে-জিরুদ-গ্রিজমানদের সামলানোয়।
শেষ চারের এই লড়াইয়ে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে মরক্কোর জমাট রক্ষণের বিপক্ষে ফ্রান্সের ফর্মে থাকা আক্রমণভাগের পারফরম্যান্স।
গ্রুপ পর্বে মরক্কোর সঙ্গী ছিল ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম ও কানাডা। সেখান থেকে দলটি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে, তা হয়তো ভাবতে পারেননি তাদের সবচেয়ে বড় ভক্তও। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে, অপরাজিত থেকে গ্রুপ সেরা হয়ে ষোলোয় জায়গা করে নেয় উত্তর আফ্রিকার দেশটি।
এরপর টাইব্রেকারে স্পেনকে হারিয়ে প্রথম আরব দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার-ফাইনালের টিকেট পায় মরক্কো। স্বপ্নের পথচলায় শেষ আটে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। ওই লড়াইয়ে ১-০ গোলে জিতে ইতিহাস গড়ে হাকিমি-জিয়াশরা। প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে জায়গা করে সেমি-ফাইনালে।
মরক্কোর এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে বড় অবদান রেখেছে রক্ষণে তাদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। এখন পর্যন্ত আসরে পাঁচ ম্যাচে একটি গোল হজম করেছে তারা, সেটিও ছিল কানাডার বিপক্ষে আত্নঘাতী গোল।
সেমি-ফাইনালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। সামনে যে ছন্দে থাকা ফ্রান্সের আক্রমণ ত্রয়ী। সর্বোচ্চ গোলস্কোরারের তালিকায় শীর্ষে আছেন কিলিয়ান এমবাপে (৫ গোল)। অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার অলিভিয়ে জিরুদ গোল করেছেন ৪টি, যার মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালের জয়সূচক গোল। এখন পর্যন্ত গোলের দেখা না পেলেও দারুণ খেলছেন ফরোয়ার্ড অঁতোয়ান গ্রিজমান। ইংলিশদের বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়ের ম্যাচে দুটি অ্যাসিস্টই করেন তিনি।
অন্যভাবে দেখলে, ফ্রান্সের জন্যও অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। শেষ ষোলো পর্যন্ত আসরে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি গোল করেছিল পর্তুগাল, ১২টি। নকআউট পর্বের প্রথম ধাপে তারা ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল সুইজারল্যান্ডকে। ফের্নান্দো সান্তোসের সেই দলকেই দারুণভাবে বেঁধে রেখে ১-০ গোলের জয় তুলে নেয় মরক্কো।
রোমাঞ্চের হাতছানিতে আসছে লড়াইয়ের মাঝেও থাকবে বেশ কিছু লড়াই। এই যেমন, এমবাপে ও মরক্কান রাইট-ব্যাক আশরাফ হাকিমির মধ্যে। পিএসজির এই দুই খেলোয়াড় মাঠের বাইরে ভালো বন্ধু। তবে ফাইনালে যাওয়ার যুদ্ধে দুজনই চাইবেন একে অন্যের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ দলকে জেতাতে।
আবার, মরক্কোর ডান দিক দিয়ে প্রতি-আক্রমণে ওঠার ক্ষেত্রে হাকিমি ও উইঙ্গার হাকিম জিয়াশের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে এই ম্যাচে, যদি এমবাপেকে আটকাতে তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়।
ফ্রান্স কোচ দিদিয়ে দেশম মনে করেন, ছোট ছোট বিষয়গুলোই ম্যাচে ব্যবধান গড়ে দেবে।
“আসরের এই পর্যায়ের লড়াইয়ে ছোট ছোট বিষয়গুলো নির্ধারক হয়ে ওঠে। কেবল মানসম্পন্ন হলেই তা যথেষ্ট নয়। তবে এই স্কোয়াডের মানসিক শক্তি আছে এবং অল্প হলেও অভিজ্ঞতা রয়েছে।"
কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী থাকার কারণে বিশ্বকাপে মরক্কোর সমর্থনের কোনো ঘাটতি হচ্ছে না। নিজ দেশের তো বটেই, আফ্রিকা ও আরব দেশগুলো থেকেও অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছে দলটি।
মরক্কো কোচ ওয়ালিদ রেগারাগির বিশ্বাস, তাদের এই সাফল্য পিছিয়ে থাকা দলগুলোকে একটা বার্তা দিতে পেরেছে। পর্তুগালকে হারানোর পর তিনি বলেন, এজন্যই চারপাশ থেকে সবার ভালবাসা পাচ্ছে তার দল।
“এই বিশ্বকাপে আমরা এমন একটা দল হয়ে উঠছি, যাদের সবাই পছন্দ করছে। কারণ আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি যে, (প্রতিপক্ষের মতো) অনেক বেশি প্রতিভা ও অর্থ না থাকলেও সফল হওয়া যায়।”
৬০ বছর আগে সবশেষ ব্রাজিল টানা দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। তাদের সেই রেকর্ড ছুঁতে ফ্রান্সের প্রয়োজন আর দুটি জয়।
প্রথম বাধা মরক্কো, আসরে ফ্রান্স যত দুর্দান্তই খেলুক না কেন, আফ্রিকার দলটির কাছে হেরে গেলে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের জন্য তা বিপর্যয় হিসেবে দেখা হতে পারে।
মরক্কোর জন্য অবশ্য খুব বেশি ভাবনার কিছু নেই। ইতিহাস গড়া দলটির পথচলা সেমি-ফাইনালে শেষ হলেও দেশে বীরের মর্যাদাই অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। ‘হারানোর কিছু নেই’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তাই মরণকামড় বসাতে চাইবে তারা।
এই লড়াইয়ে শেষ হাসি হবে কার, তা জানা যাবে আগামী বুধবার। আল বাইত স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায়।