গল্পের শেষটা লেখার অপেক্ষায় মেসি

আর্জেন্টিনা অধিনায়কের অধরা বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের জন্য পাড়ি দিতে হবে আর এক ধাপ।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2022, 03:57 PM
Updated : 16 Dec 2022, 03:57 PM

লম্বা একটা সময় ধরে ফুটবল বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন লিওনেল মেসি। তার জাদুকরী বাঁ পায়ে লেখা হয়েছে কতশত গল্প। ফুটবলের সবুজ আঙিনায় উপহার দিয়েছেন কত না স্মরণীয় মুহূর্ত। নানা রেকর্ড-অর্জনে সমৃদ্ধ তার ক্যারিয়ার। বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটাই শুধু রয়ে গেছে অধরা। নিজের শেষ বিশ্বকাপে সেই স্বপ্ন পূরণে আর্জেন্টিনা অধিনায়ককে পাড়ি দিতে হবে আর একটি ধাপ।

সেই ১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনার হাত ধরে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা, দ্বিতীয়বারের মতো। এরপর পেরিয়ে গেছে আটটি আসর। আরেকটি বিশ্বকাপ আর জেতা হয়নি তাদের। সেই আক্ষেপ ঘোচাতে প্রয়োজন শুধু একটি জয়।

মারাদোনার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার, বুয়েন্স এইরেসে ট্রফি নিয়ে যাওয়ার চাপ মেসির ওপর। নেইমার, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর মতো তারকা যেখানে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছেন আগেভাগে, মেসি সেখানে আলোকিত করে চলেছেন বিশ্ব মঞ্চ।

বয়স হয়ে গেছে ৩৫। নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ থেকে সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জয়- সামনে থেকে দলকে পথ দেখিয়েছেন অধিনায়ক। পরিসংখ্যানই তার হয়ে কথা বলছে। ছয় ম্যাচের সবগুলিতে পুরোটা খেলেছেন। নিজে গোল করেছেন ৫টি, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৩টি।

একের পর এক গড়েছেন রেকর্ড-কীর্তি। বিশ্বকাপে মারাদোনার গোল ও ম্যাচ খেলার সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছেন। গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে বিশ্ব মঞ্চে দেশের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নামলেই জার্মান গ্রেট লোথার মাথেউসকে (২৫) ছাড়িয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তার হয়ে যাবে একার।

যদিও আর্জেন্টিনার এই দলে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে মেসির অবদান বোঝানো অসম্ভব। বয়স বাড়লেও মাঠে এখনও তিনি আগের মতোই কার্যকর। সেটা গতির আচমকা পরিবর্তন, গোল করা, গোল বানিয়ে দেওয়া কিংবা আঁকাবাঁকা দৌড়ে প্রতিপক্ষকে ধাঁধায় ফেলে দেওয়া, যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন।

টুর্নামেন্টের শুরুতে সৌদি আরবের বিপক্ষে হতবাক করে দেওয়া হারের ধাক্কা সামলে তিনিই এগিয়ে নিয়েছেন দলকে। টানা পাঁচ জয়ে তারা উঠে এসেছে ফাইনালের মঞ্চে।

মেসির পাঁচ গোলের সেরাটি নিশ্চিতভাবে মেক্সিকোর বিপক্ষে বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত শটে। বাঁচা-মরার লড়াইয়ে গোলশূন্য প্রথমার্ধে চাপে পড়া দলকে পথ দেখায় সেটিই।

কোয়ার্টার-ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তার জাদুকরী পাস থেকেই গোলের আগল খোলেন নাহুয়েল মোলিনা। আসরে সেরা অ্যাসিস্ট এর তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে এটি। শেষ চারে ক্রোয়াটদের বিপক্ষে দলের তিন নম্বর গোলের ওই অ্যাসিস্টও কম কিসে।

শৈশবে স্পেনে চলে যাওয়া, অন্তর্মুখী স্বভাব এবং দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে না পারায় অতীতে আর্জেন্টাইনদের কম সমালোচনা শুনতে হয়নি মেসিকে। সেই সময় বদলে গেছে অনেক আগেই। এখন তিনি দেশের মানুষের কাছেও প্রিয়। তার উদযাপনও এখন আর্জেন্টাইন সমর্থকদের দেয় বাড়তি আনন্দ।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোলের পর যেমন প্রতিপক্ষের ডাগআউটের সামনে গিয়ে দুই কানের পাশে হাত দিয়ে উদযাপন করেন মেসি। যার লক্ষ্য ছিল ডাচ কোচ লুই ফন খাল।

ম্যাচের পর আর্জেন্টিনার এক টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আবার ডাচ স্ট্রাইকার ভঠ ভেহর্স্টের প্রতি ধমকের সুরে কথা বলেন মেসি, “এদিকে কী দেখছো, নির্বোধ?”

কেউ কেউ অবশ্য প্রতিপক্ষকে অসম্মান করায় মেসির সমালোচনা করেন। তবে অন্তর্মুখী মেসির মাঝে তেজস্বী মারাদোনার ছায়া দেখে খুশিই হন অনেক আর্জেন্টাইন সমর্থক। ওই শব্দগুলি দিয়ে কেউ কেউ আঁকেন ট্যাটু।

“নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে মেসির ‘ভেতরের মারাদোনা’ অবশেষে বেরিয়ে আসে। তারা দুজন এক। তারা চিরন্তন। তারাই আর্জেন্টিনা”- বলেন হোর্হে নামে আর্জেন্টিনার এক সমর্থক, যিনি ম্যাচটি দেখতে হাতে নিয়ে এসেছিলেন একটি পতাকা, আর তার হাতে আঁকা মেসি ও মারাদোনার ছবি।

এত প্রশংসা সত্ত্বেও সবাই জানে, মারাদোনার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে মেসিকে জিততে হবে বিশ্বকাপ, যা নির্ভর করছে ফরাসিদের হারানোর ওপর।

বার্সেলোনায় তিনি কিংবদন্তি। স্প্যানিশ দলটির হয়ে ৭৭৮ ম্যাচে তার গোল ৬৭২টি। দুটিই রেকর্ড। ২০১১-১২ মৌসুমে লা লিগায় ৫০ গোল করে ভেঙে দেন এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। গত বছর পিএসজিতে পাড়ি দেওয়ার আগে কাম্প নউয়ে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১০টি লা লিগাসহ তিনি জেতেন মোট ৩৫টি শিরোপা।

বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ব্যালন ডি’অর তার হাতে উঠেছে রেকর্ড সাতবার। আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোল স্কোরারও তিনি। চারটি ফাইনালে (২০১৪ বিশ্বকাপ, ২০০৭, ২০১৫, ২০১৬ কোপা আমেরিকা) হারের পর দেশের হয়ে গত বছর পান প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ, কোপা আমেরিকা জিতে কেটে যায় আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা।

মেসির গল্পে একটি জিনিসই শুধু বাকি এখন- বিশ্বকাপ। সেই আক্ষেপ ঘোচানোর, ‘মেসি’ নামের রূপকথার শেষ লাইন লেখার পালা এবার।