রেকর্ডের মালায় মেসির জাদুকরী রাত

চমৎকার একটি গোল করে ও করিয়ে আর্জেন্টিনার জয়ের নায়ক অধিনায়ক লিওনেল মেসি।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2022, 00:01 AM
Updated : 27 Nov 2022, 00:01 AM

ডান দিক থেকে আনহেল দি মারিয়ার পাসে বলটা বাঁ পায়ে নিয়ন্ত্রণে নিলেন লিওনেল মেসি। একটু জায়গা বানিয়ে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের নিখুঁত শট। ঝাঁপিয়ে বলের নাগাল পেলেন না গোলরক্ষক গিয়েরমো ওচোয়া। পোস্ট ঘেঁষে বল আশ্রয় খুঁজে নিল জালে। দুই হাত মেলে মেসি ছুটলেন গ্যালারির দিকে, তাকে কোলে তুলে নিলেন দি মারিয়া। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন অন্য সতীর্থরা। চলল উদযাপন।

মেসির দুর্দান্ত ওই গোলটির আগে কী বিষম চাপই না চেপে বসেছিল আর্জেন্টিনার ওপর। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে হার বিশ্বকাপে তাদের ঠেলে দিয়েছিল খাদের কিনারায়। শুরুতে ওভাবে হারের ওই ধাক্কা কতটা জোরাল ছিল, মেক্সিকোর বিপক্ষে প্রথমার্ধে মেসি-মার্তিনেসদের পারফরম্যান্সেই তা প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। মাঠে দেখা মেলে ছন্নছাড়া এক আর্জেন্টিনা দলের।

সমীকরণটা ছিল এমন- ম্যাচটি হারলেই ২০০২ সালের পর প্রথমবার বিদায় নিতে হবে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে। আর ড্র করলে সম্ভাবনা ঝুলে থাকবে অনিশ্চয়তার সুতোয়।

বাঁচা-মরার ম্যাচে প্রথমার্ধের বিবর্ণতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়াল আর্জেন্টিনা। সামনে থেকে দলকে পথ দেখালেন অধিনায়ক মেসি। লুসাইল স্টেডিয়ামে শনিবার রাতে ২-০ গোলের জয়ে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে যাওয়ার চাবিটা নিজেদের হাতেই রাখল দুবারের চ্যাম্পিয়নরা।

মেসি চমৎকার গোলটি করার পর সতীর্থের গোলেও রাখলেন অবদান। দ্বিতীয়ার্ধে বদলি নেমে এনসো ফের্নান্দেসের করা গোলটিও ছিল দেখার মতো। মেসির পাস পেয়ে বাঁ দিক দিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে এক ঝটকায় সামনের প্রতিপক্ষের বাধা এড়িয়ে নেওয়া শটে বল বাঁক খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ওচোয়াকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথম গোলটি এর চেয়ে সুন্দর হয়তো হতে পারত না ২১ বছর বয়সী মিডফিল্ডারের জন্য।

তবে ম্যাচটি সবাই মনে রাখবে মেসির জন্যই। রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী তারকা মাঠে যেমন আলো ঝলমলে পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন, রেকর্ড-পরিসংখ্যানের পাতায়ও আঁকিবুঁকি হয়েছে অনেক।

মাঠে নেমেই একটি রেকর্ডে তিনি পাশে বসেন কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনার। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ২১ ম্যাচ খেলার রেকর্ড এতদিন ছিল ২০২০ সালে ওপাড়ে পাড়ি জমানো মারাদোনার। সেখানে ভাগ বসালেন মেসি। গ্রুপের শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে নামলেই রেকর্ডটি হয়ে যাবে তার একার।

আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক মারারোনা বিশ্ব মঞ্চে ২১ ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন ৮টি। সৌদি আরব ম্যাচের পর মেক্সিকোর বিপক্ষেও জালের দেখা পেয়ে মেসিরও হয়ে গেল ৮ গোল। ১০ গোল নিয়ে আর্জেন্টাইনদের মধ্যে সবার ওপরে আছেন কেবল গাব্রিয়েল বাতিস্তুতা।

১৯৬৬ সালের টুর্নামেন্ট থেকে ধরে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে একই ম্যাচে গোল এবং গোলে সহায়তার কীর্তি মেসির আগে থেকেই। ২০০৬ আসরে সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে তিনি এই অর্জনে নাম লেখান ১৮ বছর ৩৫৭ দিন বয়সে। এবার সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবেও এই কীর্তি গড়লেন তিনি মেক্সিকোর বিপক্ষে, ৩৫ বছর ১৫৫ দিন।

বিশ্বকাপে নিজের সবশেষ চার ম্যাচেই গোলে সম্পৃক্ত থাকল মেসির নাম। গোল ও অ্যাসিস্ট, দুটোই সমান তিনটি করে।

জাতীয় দলের হয়ে টানা ৬ ম্যাচে জালের দেখা পেলেন আর্জেন্টিনার রেকর্ড গোলস্কোরার। এমনটা করে দেখিয়েছিলেন তিনি আগেও একবার, ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

মেক্সিকোর বিপক্ষে অমন পারফরম্যান্সের পর ম্যাচের সেরা তিনি অবধারিতভাবে, বিশ্বকাপে তার সপ্তমবার। বিশ্ব মঞ্চে অফিসিয়ালি কোনো খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ সেরার পুরস্কার জয়ে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে যা যৌথভাবে সর্বোচ্চ।

কাতার আসরে পর্তুগালের প্রথম ম্যাচে সেরার পুরস্কার পাওয়ার দিনে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের ভিন্ন পাঁচ আসরে গোল করার কীর্তি গড়েন রোনালদো। এবার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ভিন্ন পাঁচ আসরে অ্যাসিস্ট এর কীর্তি গড়লেন মেসি।

মেক্সিকোর বিপক্ষে তার জাদুকরী পারফরম্যান্স লুসাইল স্টেডিয়ামে বসে দেখেছেন ৮৮ হাজার ৯৬৬ জন দর্শক। গত প্রায় তিন দশকে বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে যা সর্বোচ্চ। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র আসরের ফাইনাল মাঠে বসে দেখেছিল ৯৪ হাজার দর্শক।