‘প্রেমকে এবার পরিণয়ে’ রূপ দেওয়ার পালা নেইমারের

ব্রাজিলিয়ান তারকা নিজেই বলেছেন, ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে ঈর্ষাপরায়ণ মেয়ে, বঞ্চিত হলে সেও করবে পাল্টা আঘাত!

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2022, 07:35 AM
Updated : 24 Nov 2022, 07:35 AM

ফুটবলের সঙ্গে নেইমারের প্রেম সেই শৈশব থেকে। দিনে দিনে সে সম্পর্কের বয়সও হয়ে গেছে ৩০ বছর। এখন বিশ্বকাপের মঞ্চে পরিণয়ে রূপ দেওয়ার পালা। ব্যর্থ হলে যে বড্ড বিপদ। নেইমার নিজেই তো বলেছেন, ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে ঈর্ষাপরায়ণ মেয়ে, বঞ্চিত হলে সেও করবে পাল্টা আঘাত!

সাও পাওলো থেকে ফুটবল-নেইমার জুটির পথচলা শুরু। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, সম্পর্কের গভীরতা, বিশ্বস্ততা, বোঝাপড়া বেড়েছে। চোটের থাবায় মাঝেমধ্যে ক্ষণিকের তরে থমকে যেতে হয়েছে বটে, কিন্তু বন্ধনটুকু ছিন্ন হয়নি কখনও। অনেকটা পথ একসঙ্গে হেঁটে, কিছু সাফল্যের নুড়ি-পাথর কুড়োনোর তৃপ্তি নিয়ে এই জুটির পা পড়েছে কাতারের মরুদ্যানে।

সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বৃহস্পতিবার কাতার বিশ্বকাপ শুরু করবে ব্রাজিল। পরীক্ষা শুরু হবে নেইমারের। সাফল্য, ব্যর্থতার হিসেব অবশ্য তোলা থাকবে সময়ের হাতে। কিন্তু নেইমার জানেন, বিশ্বকাপ জয়ের মধ্যে লুকিয়ে তার ফুটবল প্রেমের সফল পরিণতি।

এশিয়া থেকে সবশেষ শিরোপা নিয়ে ঘরে ফেরা ব্রাজিলের; সেই ২০০২ সালে কোরিয়া-জাপানের আসরে। ২০০৬-এ ‘দা ফেনোমেনোন’ রোনালদো-রোনালদিনিয়োরা পারেননি সাফল্যের রাশ টেনে নিতে। দক্ষিণ আফ্রিকার পরের আসরে রবিনিয়ো-ফাবিয়ানোরা ব্যর্থ। ২০১৪ সালে ব্রাজিল সাওয়ার হলো নেইমারের কাঁধে। ফুটবল  ও নেইমার জুটির তখন দারুণ সুসময়। ফরতালেজায় কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনাল পর্যন্ত সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক।

২-১ গোলে জেতা ওই ম্যাচে কামিলা সুনিগার সেই ভয়ঙ্কর ফাউল। উড়ে এসে হাঁটু দিয়ে শিরদাঁড়ায় আঘাত করে বসলেন কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মাঠে লুটিয়ে পড়লেন নেইমার, চোটে শেষই হল তার বিশ্বকাপ। নিজেদের আঙিনায় ট্রফি উঁচিয়ে ধরার ব্রাজিলের স্বপ্নও গুঁড়িয়ে গেল সেমি-ফাইনালে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে। আসরে নেইমার গোল করেছিলেন ৪টি।

২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে ফুটবলের সঙ্গে যেন একটু টানাপোড়েন চলছিল নেইমারের। সামারায়, সেন্ট পিটার্সবার্গে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে একটু-আধটু ঝলক দেখালেন, কিন্তু কাজানে কোয়ার্টার-ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ছিলেন বিবর্ণ। ব্রাজিল হারল ২-১ ব্যবধানে। মাত্র ২ গোলের মলিন পরিসংখ্যান নিয়ে বিশ্বকাপ শেষ হয় নেইমারেরও।

ইদানিং ফুটবলের সঙ্গে তার প্রেম ফের জমে উঠেছে। পিএসজির হয়ে দারুণ ছন্দে আছেন ৩০ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। চলতি মৌসুমে খেলা ২০ ম্যাচে ১৫ গোল, ১২টি অ্যাসিস্ট। মানে স্কোরিংয়ের পাশাপাশি আক্রমণের সুরও বেঁধে দিচ্ছেন নিয়মিত। পিএসজি সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপের সঙ্গে ‘বাহাসের প্রসঙ্গ’ বাদ দিলে সবকিছু আছে ঠিকঠাক।

ফুটবলের প্রতি তার নিবেদন, নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন নেই। সুন্দর ফুটবলের সুর তার প্রতিটি মুভে, ড্রিবলিংয়ে, পাসে, শটে, এমনকি হেডেও। যদিও প্রতিপক্ষের আলতো ট্যাকলে লুটিয়ে পড়ার কারণে অনেকে কাটাক্ষ করে ‘নাটুকে’ বলে, কিন্তু তাকে আটকাতে প্রতিপক্ষের প্রাণান্ত চেষ্টা, ফাউল করার পরিসংখ্যানের খবর হয়তো অনেকে রাখেন না। ২০২২-২৩ মৌসুমে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ৬৬ ফাউলের শিকার হওয়া খেলোয়াড়টি কিন্তু নেইমার। রাশিয়া বিশ্বকাপে তাকে দমাতে পাঁচ ম্যাচে ফাউল করা হয় ২৬ বার!

কাতারে কতবার এর শিকার হতে হবে কে জানে? কিন্ত প্রতিপক্ষ পথ রোধ করে দাঁড়ালেও তার থেমে যাওয়ার সময় নেই। মূল ফরোয়ার্ড কিংবা প্লে-মেকার যে ভূমিকাতেই তিতে খেলান না কেন, গন্তব্যে পৌঁছুতে তাকে ছুটতে হবে মরুঝড়ের বেগে। একে একে মেলাতে হবে অনেক বকেয়া হিসাব, সাড়া দিতে হবে প্রাপ্তির হাতছানিতে।

৭৭ গোল নিয়ে আজও সেলেসাওদের সর্বোচ্চ গোলদাতা পেলে। দুই গোল কম নিয়ে এই কিংবদন্তির ঠিক পেছনেই নেইমার। দোহার আসরে তিনবার গোলের ফুল ফোটাতে পারলেই পেলের এই সিংহাসন হয়ে যাবে তার একার!

ক্লাব ফুটবলের অনেক হিসেব তিনি মিলিয়েছেন। শৈশবে-কৈশরে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন সাও পাওলোর অলি-গলিতে। জাদু দেখিয়েছেন সান্তোসের আঙিনায়। যৌবনের অনেকটা সময় বার্সেলোনার জার্সিতে উপহার দিয়েছেন সুরেলা ফুটবল। এখন নেইমার উড়ছেন প্যারিসে। ক্লাব ফুটবলে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬টি ট্রফি জিতেছেন, কিন্তু ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে এখন বড্ড মলিন তিনি। সেলেসাওদের হয়ে এখন পর্যন্ত সেরা অর্জন ২০১৩ সালের কনফেডারেশন কাপ!

এবারের বিশ্বকাপের গল্পটা সাফল্যের রঙ-তুলিতে আঁকতে মুখিয়ে নেইমার। যদিও তিনি নিঃশ্চুপ, গণমাধ্যম থেকে দূরে। কিন্তু আল আরাবি স্পোর্টস ক্লাবের ভেন্যুতে নেওয়া প্রস্তুতিতে ঠিকই দেখিয়েছেন বল তার কথা শুনছে ‘কিপি-আপি’তে, শট নেওয়ার, পাস দেওয়ার সময় । ড্রিবলিংয়ের সময় তার পা আর বল যেন গল্প করছে ফিসফিস করে।

‘প্রেম’ টিকিয়ে রাখতে নেইমারকে এই গল্প চালিয়ে যেতে হবে। পরিণয়ে রূপ দিতে হলে জিততে হবে বিশ্বকাপ। অন্যথায় কি হতে পারে, সেটা নেইমার নিজেই বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে।

“ফুটবল হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে ঈর্ষাপরায়ণ মেয়েটির মতো। যদি তুমি তাকে ঠিকঠাক না ভালোবাসো, সেও তোমাকে ভালোবাসবে না, এমনকি সে তোমাকে আঘাতও দিতে পারে। আমি তাকে খুব ভালোবাসি।”