প্যারিস অলিম্পিকস
চোট লুকিয়ে অলিম্পিকসের ট্র্যাকে নামতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানব, অভিযোগ অস্বীকার করলেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব মন্টু।
Published : 03 Aug 2024, 06:21 PM
স্টেডিয়ামের লাউড স্পিকারে যখন ঘোষণা করা হলো ইমরানুর রহমানের নাম, ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে তার মুখের হাসিটা কেমন যেন ফিকে মনে হলো। দৌড়ের শুরুটা অবশ্য ভালোই করলেন তিনি, কিন্তু শেষ দিকে পিছিয়ে পড়লেন অনেকটাই। শেষ পর্যন্ত নিজের হিটে তিনি আট জনের মধ্যে হলেন ষষ্ঠ। টাইমিংও চরম হতাশাজনক। তবে বাংলাদেশের দ্রুততম মানব বিস্ময় ছড়ালেন পরে। স্রেফ বিস্ময় না বলে সেটিকে বলা যায়, বিস্ফোরণ।
ইমরানুরের দাবি, গত মার্চ থেকে তলপেটের চোট বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তলপেটের পেশি ছিঁড়ে গেছে বেশ আগেই! চোটের কারণে অনুশীলনও করতে পারেননি লম্বা সময়। গত প্রায় ৫ মাসে তিনি ৫০-৬০ মিটারের বেশি দৌড় অনুশীলনও করেনি। তার দাবি, বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনকে তিনি নিজের অবস্থার কথা জানিয়েছেন বারবার। কিন্তু ফেডারেশন থেকে তাকে এই তথ্য গোপন করতে বলা হয়েছে এবং অলিম্পিকে দৌড়াতে বাধ্য করা হয়েছে।
ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব মন্টুর কাছে যখন এটির কারণ জানতে চাইলেন বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা, তখন হুট করে তেতে উঠলেন তার পাশে থাকা শেফ দা মিশন ও বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে তিনি দাবি করলেন, ইমরানুর ইতিহাস গড়েছেন এবং দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছেন! তার সঙ্গে সায় দিলেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকও! অথচ সত্যিটা হলো, ১০ দশমিক ৭৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে, প্রাথমিক পর্বের ৬টি হিট মিলিয়ে ৪৫ জনের মধ্যে ২৫তম হয়ে ইমরানুর বাদ পড়ে গেছেন।
ইমরানুরের চোটের খবর ফেডারেশন জানে না এবং এই স্প্রিন্টার তাদেরকে এসব কিছু জানায়নি বলেও বারবার দাবি করলেন সাধারণ সম্পাদক।
ইমরানের চোট, তা লুকানো, ফেডারেশনের অস্বীকার, তার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার ভুল তথ্য নিয়ে কর্তাদের এমন দম্ভ ও হম্বিতম্বি, সবকিছুতেই যেন ফুটে উঠছে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস তথা ক্রীড়াঙ্গনের অসুস্থ চিত্র।
১০০ মিটার স্প্রিন্টে বাংলাদেশ বা ইমরানুর দারুণ কিছু করবে, এমন আশা সম্ভবত করেননি দেশের কেউ। তবে গত দেড় বছরে আশার পারদটা তিনি এতটুকু ওপরে নিতে পেরেছিলেন যে, অন্তত নিজেকে ছাড়িয়ে যাবেন বা দু-একটি ধাপ পার হবেন। তার নিজের সেরা টাইমিং ১০.১১, গত এশিয়াডে তিনি করেছেন ১০.৪৪।
স্তাদ দে ফ্রান্সের ট্র্যাকে শনিবার প্রথম ৫০-৬০ মিটার পর্যন্ত বেশ এগিয়েই ছিলেন তিনি। পরে খেই হারান। দৌড় শেষে মিক্সড জোনে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে শুরুতে তিনি বললেন, “চেষ্টার কমতি রাখিনি…।” এত বাজে টাইমিং তার সবশেষ কবে হয়েছে, সেটাও তিনি মনে করতে পারলেন না।
প্রথাগত নানা কথার সঙ্গে এক পর্যায়ে বললেন, “খুব ভালো করতে পারিনি…অনেক কারণেই এটা ছিল বছরে আমার প্রথম ১০০ মিটার… আসলে এসব নিয়ে এই মুহূর্তে খুব একটা কথা বলতে চাই না। আপনারা যা দেখেছেন, নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারেন…।”
কোনো একটা রহস্যের ইঙ্গিত মিলল তাতেই। পরে এক পর্যায়ে তিনি মনের দুয়ার খুলে দিয়েই জানালেন চোটের বিস্তারিত।
ইমরানুর যা জানালেন, গত মার্চে গ্লাসগোতে বিশ্ব ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে গিয়ে তিনি এই চোটের অস্তিত্ব প্রথম টের পান। একটি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশে গিয়ে তিনি স্ক্যান করান এবং নিশ্চিত হন যে, চোট আছে। ফেডারেশনকে তিনি চোটের কথা জানান। তবে তখনও তা গুরুতর ছিল না।
ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা এই অ্যাথলেট থাকেন বার্মিংহামে, নিজস্ব কোচের সঙ্গে অনুশীলন করেন সেখানেই। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে তিনি ট্র্যাকে অনুশীলনে নামেন। কিন্তু চোট আরও বাজে আকার ধারণ করে, এবার তলপেটের পেশি ছিঁড়ে যায়।
ইমরানুরের দাবি, নিজের ভবিষ্যৎ তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন এবং ফেডারেশনকে তা জানান। কিন্তু ফেডারেশন থেকে তাকে বলা হয়, এটা গোপন করে সেরে ওঠার চেষ্টা করে যেতে। চোট কাটিয়ে উঠতে তখন লম্বা সময় পুরোপুরি বিশ্রামে থাকেন তিনি। পরে ট্র্যাকে ফিরে টুকটাক অনুশীলন করলেও পুরো ‘ইনটেনসিটি’ দিয়ে দৌড়ানো তো বহুদূর, ১০০ মিটার দৌড়াতেই পারছিলেন না তিনি। এক পর্যায়ে তার কোচও তাকে সাফ জানিয়ে দেন, অলিম্পিকে দৌড়ানোর মতো অবস্থায় তিনি নেই।
ইমরানুর জানালেন, গত জুন মাসে জানতে পারেন যে, অস্ত্রোপচার ছাড়া এই চোট থেকে সেরে ওঠার উপায় নেই এবং দ্রুতই তিনি তা ফেডারেশনকে জানান। কিন্তু ফেডারেশন থেকে এবারও তাকে বলা হয় চোটের কথা গোপন রেখে প্রস্তুতি নিতে। শেষ পর্যন্ত, সপ্তাহ তিনেক আগে থেকে তিনি অনুশীলন শুরু করেন। কিন্তু যথারীতি প্রবল অস্বস্তি ছিলই এবং ৫০-৬০ মিটারের বেশি দৌড়াননি তিনি গত মার্চের পর থেকে। এই বছর তিনি ১০০ মিটারে লড়তে প্রথমবার ট্র্যাকে নামলেন অলিম্পিকেই!
ইমরানুর বললেন, নিজের অবস্থা জানেন বলেই স্টেডিয়ামের ঘোষক তার নাম ঘোষণা করার সময় স্বস্তস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস তিনি দেখাতে পারেননি। কারণ, তার মনে প্রবল শঙ্কা বাসা বেঁধেছিল। এমনকি তার মনে এরকম ভাবনাও এসেছে যে, ফলস স্টার্ট করে লড়াই শুরুর আগে ছিটকে গেলেও মন্দ হয় না। তিনি কেবল ভাবছিলেন, কখন এই দৌড় শেষ হবে…! ১০০ মিটার পুরোপুরি শেষ করতে পারবেন কি না, এটা নিয়েও তার নিজেরই সংশয় ছিল প্রচণ্ড।
অথচ লড়াইয়ের আগের দিনও দেশের দ্রুততম তারকা বলেছেন, তার প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো হয়েছে এবং দারুণ আত্মবিশ্বাসী তিনি। গত কিছুদিনেও নানা সাক্ষাৎকারে তিনি আশার কথাই শুনিয়েছেন। প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে যায়, ব্যর্থতার পর তাহলে কেন এমন বোমা ফাটাচ্ছেন!
ইমরানুর আবারও দাবি করলেন, তিনি প্রতি মাসেই নিজের চোটের ‘আপডেট’ ফেডারেশনকে জানিয়েছেন এবং নিজের অলিম্পিকস স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বলেছেন, অন্য কাউকে যেন নেওয়া হয়। কিন্তু ফেডারেশন থেকে বারবারই তাকে বাধ্য করা হয়েছে চোট গোপন করতে এবং এই কথা কোনোভাবেই প্রকাশ না করতে বা সংবাদমাধ্যমকে না জানাতে।
লড়াইয়ে ব্যর্থতার পর চোটের কথা বলায় দেশের মানুষের কাছে তার নিবেদন, গ্রহণযোগ্যতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এটি স্বীকার করে নিলেন ইমরানুর। অনেকটা অসহায় চাহনি ও কণ্ঠে তিনি বারবার বললেন, তাকে বাধ্য করা হয়েছে সত্যিটা গোপন করতে।
লন্ডনে গিয়ে পরীক্ষা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানালেন ইমরানুর। ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে অশ্চিয়তার কথাও অকপটে বললেন ৩১ বছর বয়সী স্প্রিন্টার। হতাশ পদক্ষেপে পরে তিনি চলে গেলেন নিয়মিত ডোপ পরীক্ষায় অংশ নিতে।
বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা তখন ছুটলেন অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব মন্টুর কাছে তাদের ব্যাখ্যা নিতে। কিন্তু আলোচনা সেভাবে শুরুর আগেই হুট করে জ্বলে উঠলেন শেফ দা মিশন ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। চিৎকার করে সংবাদকর্মীদের বলতে থাকলেন, “তোমরা এত নেতিবাচক কেন? কেন তোমরা ইমরানের সঙ্গে এখনই কথা বলতে গিয়েছো? তোমরা তো কিছুই জানো না, ইমরান ইতিহাস গড়েছে, দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে। কিছু না জেনেই তোমরা নেতিবাচক কথা বলছো কেন?”
সংবাদকর্মীদের সঙ্গে ইমরানুর কথা বলেছেন মিক্সড জোনে, যেটা অলিম্পিকের নিয়ম এবং যেখানে আসার বাধ্যবাধকতা আছে অ্যাথলেটদের। সেটা জানানো হলো শেফ দা মিশনকে এবং তাকে এটাও বলা হলো যে, ইমরানুর নিজেও জানেন না যে, তিনি দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছেন। তখন তিনি মারমুখি ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে একজন সংবাদকর্মীর অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ধরে টানাটানি করে আরও গলা উঁচিয়ে বললেন, “আমি শেফ দা মিশন… আমি সব জানি…।”
মজার ব্যাপার হলো, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব মন্টু নিজেও বারবার দাবি করলেন, ইমরানুর দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছেন। এক পর্যায়ে সংবাদকর্মীরা তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, ইমরানুর আসলে বাদ পড়ে গেছেন এবং দ্বিতীয় রাউন্ডের লাইন আপ দেখে তিনি তা নিশ্চিত হলেন। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকই যখন নিয়ম জানেন না, সেই ফেডারেশনের অবস্থা বোধগম্য!
অথচ বিশ্বজুড়ে ইমরানুরের প্রতিটি দৌড়ে তার সঙ্গে কোচ না পাঠানো হলেও সাধারণ সম্পাদককে সবসময়ই দেখা যায় সঙ্গী হতে।
ইমরানুরের চোট ও ফেডারেশনকে জানানোর দাবিও স্রেফ উড়িয়ে দিলেন সাধারণক সম্পাদক।
“জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের সময় (জানুয়ারিতে) সে একটা চোটের কথা বলেছিল। এরপর আর কোনো কিছু কখনও বলেনি। তার চোটের অবস্থা ভালো নয় বা সে লড়তে চায় না, এসব আমরা কিছুই জানি না। সামান্য ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি আমাদের। ইমরানুর না দৌড়ালে জহির (জহির রায়হান) বা অন্যরা তো ছিলই। আমাদের তো অ্যাথলেটের অভাব নেই। ইনজুরড অ্যাথলেটকে কেন আমরা অলিম্পিকে আনব। আমরা এসবের কিছুই জানি না।”
একবার-দুবার নয়, বারবার তিনি জানান যে, ইমরানুর তাদেরকে চোটের কথা জানাননি।
যার কথাই সত্যি হোক বা বাস্তবতা যেটাই হোক, হয়তো বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস ইতিহাসের চরম বিতর্কিত ও কলঙ্কিত একটি অধ্যায় হয়েই থাকবে এটি।