স্প্যানিশ ফুটবল
Published : 27 Apr 2025, 09:46 PM
হয়ে গেল আরেকটি নতুন ক্লাসিকো দ্বৈরথ, তবে গল্পটা রয়ে গেল পুরোনো, ফলটা আগের মতোই। গত মৌসুমে তিনটি ক্লাসিকোর সবকটি জিতেছিল রেয়াল মাদ্রিদ। এই মৌসুমে প্রথম তিন ক্লাসিকোর প্রতিটিতে জয় বার্সেলোনার। সবশেষ, কোপা দেল রের ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হেরেছে ইউরোপের সফলতম ক্লাব। যে ম্যাচের আগে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন রেফারি। তবে রেফারিদের নিয়ে না ভেবে, রেয়াল মাদ্রিদকে বরং মনোযোগ দিতে হবে আরও অনেক জায়গায়, সেটিই যেন দেখিয়ে দিল এই ফাইনাল।
সেভিয়ায় শনিবার রাতে স্পেনের দ্বিতীয় সেরা প্রতিযোগিতাটির রোমাঞ্চকর ফাইনালে রেয়ালকে ৩-২ গোলে হারিয়ে শিরোপা উৎসব করে বার্সেলোনা।
পেদ্রির চমৎকার গোলে প্রথমার্ধে এগিয়ে যায় বার্সেলোনা। দ্বিতীয়ার্ধে আট মিনিটের মধ্যে কিলিয়ান এমবাপে ফ্রি কিকে সমতা ফেরানোর পর রেয়ালকে এগিয়ে নেন অহেলিয়া চুয়ামেনি। ৮৪তম মিনিটে প্রতি আক্রমণ থেকে সমতা ফেরান ফেররান তরেস। এরপর অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো লড়াইয়ে ১১৬তম মিনিটে জুল কুন্দের গোল গড়ে দেয় পার্থক্য।
৯৬তম মিনিটে পেনাল্টির সিদ্ধান্তে রেফারি নাটকীয়তা তুঙ্গে
রেয়াল মাদ্রিদের দৃষ্টিকোণ থেকে আতশ কাচের নিচে ছিলেন ফাইনালের রেফারি রিকার্দো দে বুর্গোস বেনগোচেয়া ও ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি গনসালেস ফুয়ের্তেস। ম্যাচের আগের দিনের ঘটনাপ্রবাহ তৈরি করে দেয় এই পরিস্থিতি। ম্যাচে রেফারিদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করে রেয়াল মাদ্রিদের নিজস্ব টিভি চ্যানেল আরএমটিভির প্রকাশিত ভিডিওর পাল্টা সমালোচনা করেন এই দুজন।
আরএমটিভির সমালোচনার কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপ নিয়ে শুক্রবার সম্মেলনে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন দে বুর্গোস। সেখানে গনসালেস ফুয়ের্তেস হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আরএমটিভির বিরুদ্ধে শিগগিরই ‘ব্যবস্থা নেবেন’ তারা। এর জেরে এই দুজনকে ফাইনাল থেকে অপসারণের দাবি রেয়াল জানালেও, তা খারিজ করে দেয় স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন।
পরে অনুশীলন, সংবাদ সম্মেলনসহ ম্যাচের আগের দিনের সব আনুষ্ঠানিকতা বয়কট করে রেয়াল। তারা ফাইনাল নাও খেলতে পারে বলে খবর আসতে শুরু করে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমে। সেটিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে ক্লাবটি।
সব মিলিয়ে দে বুর্গোস ফাইনালে মাঠে নামার মুহূর্ত থেকে এবং গনসালেস ফুয়ের্তেসের ভিএআর বুথে, তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, সেটি বিতর্কিত হোক বা না হোক, সবকিছুতে ছিল বাড়তি নজর।
যদিও প্রথমার্ধে বলা যায় অনেকগুলো সিদ্ধান্তই পক্ষে গেছে রেয়ালের। ষোড়শ মিনিটে বক্সে ফেদেরিকো ভালভের্দের হাতে বল লাগার পর বার্সেলোনার পেনাল্টির আবেদনে সাড়া দেননি রেফারি। লামিনে ইয়ামালকে ট্যাকলের জন্য দানি সেবাইয়োসকে কার্ড না দেওয়া ও দানি ওলমোকে ফাউলের জন্য অহেলিয়া চুয়ামেনিকে লাল কার্ডের বদলে হলুদ কার্ড দেওয়ায় অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে বার্সেলোনা।
ইয়ামালের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্যও সেবাইয়োস শাস্তি পাননি এবং ৪৩তম মিনিটে আরেকবার তিনি বেঁচে যান, যখন পাউ কুবার্সির জার্সি টেনে ধরার জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২-২ স্কোরলাইনে দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে রেয়ালের বক্সে তাদের ডিফেন্ডার রাউল আসেন্সিওর বাধা দেওয়ার চেষ্টায় রাফিনিয়া পড়ে গেলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। বার্সেলোনা সমর্থকরা তখন উচ্ছ্বসিত। তাদের সামনে জয়ের হাতছানি। কিন্তু ভিএআরে পর্যবেক্ষণ করা হয় দীর্ঘ সময়। গনসালেস ফুয়ের্তেস মাঠের পাশে মনিটরে ঘটনাটি আবার দেখার জন্য ডেকে পাঠান রেফারি দে বুর্গোসকে। শেষ পর্যন্ত আগের সিদ্ধান্ত পাল্টান তিনি।
শুরুতে এটিকে পেনাল্টি বলেই মনে হচ্ছিল। তবে রিপ্লে দেখে মনে হয়, রাফিনিয়া অনেক সহজেই মাঠে পড়ে গেছেন। ডাইভ দেওয়ায় তাকে হলুদ কার্ড দেন রেফারি। তখন পর্যন্ত ম্যাচের সম্ভাব্য সেরা ওই মুহূর্তও রেয়ালের পক্ষেই যায়।
অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকে আন্টোনিও রুডিগার, লুকাস ভাসকেস ও জুড বেলিংহ্যামকে রেফারির লাল কার্ড দেখানো নিয়েও বিতর্কের অবকাশ খুব একটা নেই। রেফারির দিকে বস্তু ছুড়ে মারার জন্য রুডিগার বরং বড় ধরনের শাস্তির অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচে রেফারিং নিয়ে রেয়ালের খুব একটা অভিযোগ থাকার কথা নয়।
এই মৌসুমে অনেকবারই রেফারিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রেয়ালের কোচ ও খেলোয়াড়রা। গত ফেব্রুয়ারিতে লা লিগায় এস্পানিওলের বিপক্ষে হারের পর তো স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন ও স্পেনের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে একটি খোলা চিঠি দিয়ে ম্যাচ অফিসিয়ালদের বিরুদ্ধে ‘প্রতারণা’ ও ‘দুর্নীতির’ অভিযোগও করে তারা।
তাদের সমালোচনা করে তখন লা লিগা সভাপতি হাভিয়ের তেবাস বলেছিলেন, নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ক্লাবটি। কান্নাকাটি করে রেয়াল ‘মিথ্যা গল্প’ বানাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
ক্লাসিকোয় ফ্লিকের আধিপত্য
গত মৌসুমে শাভি এর্নান্দেসের কোচিংয়ে রেয়ালের বিপক্ষে লা লিগায় দুইবারের দেখাতেই (২-১, ৩-২) ও স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে (৪-১) হেরেছিল বার্সেলোনা। এবার হান্সি ফ্লিকের হাত ধরে দুর্বার গতিতে ছুটছে কাতালান দলটি। মৌসুমে আগের দুটি ক্লাসিকোয় তারা জিতেছে প্রবল দাপটে, অক্টোবরে বের্নাবেউয়ে লা লিগায় ৪-০ গোলে ও জানুয়ারিতে স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে ৫-২ গোলে।
কোপা দেল রের ফাইনালেও প্রথমার্ধে ছিল বার্সেলোনার একচেটিয়া দাপট। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করেছে তারা ৩২তম ট্রফি জিতে। ২০২৫ সালে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে স্রেফ একটি ম্যাচে হেরেছে তারা।
বেঞ্চ থেকে নেমে এমবাপের ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে আর্সেনালের বিপক্ষে অ্যাঙ্কেলে চোট পাওয়ায় ফাইনালে শুরুর একাদশে ছিলেন না এমবাপে। তার অনুপস্থিতিতে ভিনিসিউস জুনিয়রকে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে বেছে নেন কোচ কার্লো আনচেলত্তি। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের পেছনে রাখা হয় জুড বেলিংহ্যামকে, এক পাশে রদ্রিগোকে।
প্রথমার্ধে আক্রমণে তেমন কিছুই করতে পারেনি রেয়াল। এই সময়ে তারা গোলের জন্য শট নিতে পারে স্রেফ একটি, সেটিও ছিল না লক্ষ্যে। বিপরীতে প্রথমার্ধে বার্সেলোনা গোলে শট নেয় ৯টি।
প্রথমার্ধের শেষ দিকে বার্সেলোনার বক্সে পড়ে যান ভিনিসিউস, তার আগেই অবশ্য অফসাইডে ছিলেন তিনি। এমবাপেকে তখন ওয়ার্ম আপ করতে দেখা যায় টাচলাইনে। বিরতির পর ফরাসি তারকা অন্যদের সঙ্গে মাঠে নামেন রদ্রিগোর বদলি হিসেবে।
এমবাপে নামার পরই বদলাতে শুরু করে চিত্র। একের পর এক সুযোগ তৈরি করতে থাকে রেয়াল। কয়েক দফায় গোলরক্ষক ভয়চেখ স্ট্যান্সনির দৃঢ়তায় রক্ষা পায় বার্সেলোনা। ৭০তম মিনিটে আর পারেননি তিনি। ক্যারিয়ারে প্রথম সরাসরি ফ্রি কিকে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান বিশ্বকাপ জয়ী এমবাপে।
এই মৌসুমে চারটি ফাইনাল খেলেছে রেয়াল- উয়েফা সুপার কাপ, ফিফা ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও কোপা দেল রে; প্রতিটিতেই গোল করলেন এমবাপে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি ভালো করতে পারেননি ঠিকই। অনেকের মতে, কিছু দিক বিচারে পিএসজি থেকে তার আগমন দলকে কিছুটা ভারসাম্যহীনই করে তুলেছে। তবে দারুণ প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়কে ঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে রেয়ালে তিনি সাফল্য পেতে পারেন, এমনকি যদি এই মৌসুম হতাশার মধ্য দিয়েও শেষ হয়।
সাত মিনিট পর চুয়ামানির গোল এগিয়ে দেয় রেয়ালকে। এই অর্ধে শ্রেয়তর দল ছিল তারাই। খেলার ধারার বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের ছয় মিনিট বাকি থাকতে ফেররান তরেস সমতায় ফেরান বার্সেলোনাকে।
রেয়ালের সামনে কী
দুই লেগ মিলিয়ে আর্সেনালের বিপক্ষে বিধ্বস্ত হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের-কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়ের ১০ দিন পর কোপা দেল রের ফাইনালে হারের বিষাদ সঙ্গী হলো রেয়ালের। লা লিগার শিরোপা লড়াইয়ে যদিও এখনও টিকে আছে তারা, তবে সেখানেও আশা জোরাল নয়। বাকি আছে আর পাঁচ রাউন্ড।
এবার লিগে একসময়ে ৯ পয়েন্ট এগিয়ে শীর্ষে ছিল রেয়াল। সেই তারা এখন দুইয়ে আছে চূড়ায় থাকা বার্সেলোনার চেয়ে ৪ পয়েন্টে পেছনে থেকে।
শনিবারের ফাইনালে আনচেলত্তির দলের দ্বিতীয়ার্ধের পারফরম্যান্স ছিল আশা জাগানিয়া। এখন লা লিগায় তারা ভালো কিছু করতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
রেয়ালের এই শেষের শুরুটা হবে সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে পরীক্ষা দিয়ে। এরপর আরও কঠিন পরীক্ষা, আরেকটি ক্লাসিকো, এবার খেলা বার্সেলোনার মাঠে। আগামী ১১ মের ওই ম্যাচকে বলা হচ্ছে লিগ শিরোপা নির্ধারক।
ওই লড়াইয়ে জিততে ব্যর্থ হলে বড় কোনো শিরোপা ছাড়াই মৌসুম শেষ করতে হবে রেয়ালকে। কোচ আনচেলত্তির চাকরি অনিশ্চয়তায় সুতোয় ঝুলছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায়ের পর থেকেই। লা লিগায়ও ব্যর্থ হলে মৌসুমে শেষে বরখাস্ত হতে পারেন অভিজ্ঞ ইতালিয়ান কোচ।