কোপা আমেরিকা
প্রায় ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন আনহেল দি মারিয়া।
Published : 15 Jul 2024, 10:30 AM
‘ছোটবেলায় আমি খুব পাজি ছিলাম। ঠিক খারাপ বলব না। তবে খুবই চঞ্চল ছিলাম। ঘরেই দোকান খুলে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতেন মা। একদিন দরজা খোলা পেয়ে দৌড়ে বাইরে চলে যাই। অল্পের জন্য সেদিন গাড়ির নিচে পড়িনি। সেদিন থেকে আমাদের দোকান বন্ধ। তবে ছুটাছুটির স্বভাব খুলে দেয় নতুন দুয়ার’- নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন আনহেল দি মারিয়া।
সারাদিন ছেলের দস্যিপনা ও ঘরজুড়ে দৌড়াদৌড়িতে চিন্তিত হয়ে পড়েন মা দিয়ানা হার্নান্দেস। নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে। সেই চিকিৎসক চার বছর বয়সী দি মারিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কী করো? ফুটবল খেলো?’ সেদিন থেকেই শুরু আর্জেন্টিনার রোসারিওর ছোট্ট গ্রাম পেদ্রিয়েলে বেড়ে ওঠা দি মারিয়া শুরু করেন নতুন দৌড়, ফুটবলের দৌড়।
নব্বইয়ের দশকে শুরু হওয়া সেই দৌড়ের একটি অধ্যায়ের পর্দা নামল এবার। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানালেন আর্জেন্টিনার ‘ফাইনালের নায়ক।’ ২০০৮ অলিম্পিকের পর ২০২১ কোপা আমেরিকা, ২০২২ সালের ফিনালিস্সিমা ও একই বছরের ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনালেও গোল করেন জাতীয় দলের হয়ে ১৪৫ ম্যাচ খেলা দি মারিয়া।
সাফল্যমণ্ডিত এই যাত্রার শুরুতেই এক অন্যরকম পরীক্ষায় পড়েন দি মারিয়া। বাবা মিগেল দি মারিয়া নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের পাড় সমর্থক। আর মা দিয়ানা রোসারিও সেন্ত্রালের অন্ধ ভক্ত। দুই ক্লাবের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও চরমে। শেষমেশ মায়ের ইচ্ছাই জয়ী হয়। রোসারিও সেন্ত্রালের হয়ে শুরু হয় দি মারিয়ার ফুটবলের পাঠ। একই সময়ে নিওয়েলস মাতান পরে দি মারিয়ার কাছের বন্ধু হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনার মহাতারকা লিওনেল মেসি।
দি মারিয়ার ছোট বেলায় তার পরিবার পড়ে যায় বড় ঝামেলায়। এতে দায় বেশি ছিল তার বাবারই। প্রতিবেশির ঋণের জামিনদার হয়ে মিগেল আটকা পড়েন বড় ঋণের ফাঁদে। দোকান বন্ধ হওয়ার পর জীবন ধারনের জন্য কয়লার ব্যবসায় নেমে পড়তে হয় তাদের। ঘরের পেছন থেকে বসার ঘর হয়ে সামনের দরজা পর্যন্ত কয়লার ব্যাগ টেনে আনার ফলে সাদা রঙের ঘরের দেয়াল ধীরে ধীরে পুরোপুরি কালো হয়ে যায়।
তবে ফুটবল ক্যারিয়ারে কোনো জার্সির গায়ে কালি লাগতে দেননি দি মারিয়া। আর্জেন্টিনার আকাশি নীল ও সাদা জার্সির পাশাপাশি রেয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সিতে তিনি কাটান ক্যারিয়ারের সেরা সময়। জাতীয় দলের হয়ে কোপা আমেরিকা, বিশ্বকাপের পাশাপাশি রেয়ালের হয়ে জেতেন লা লিগা ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। ইউরোপের সফলতম দলটির ‘লা দেসিমা’ জয়ের পথে তিনিই ছিলেন ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়।
রোসারিও সেন্ত্রাল ক্লাবটি ছিল শহরের আরেক প্রান্তে। মায়ের জেদে এই ক্লাবে নাম লেখানোয় মা-ই নেন তাকে প্রতিদিন ক্লাবে নেওয়ার দায়িত্ব। তখন দি মারিয়ার জীবনে ঘটে গ্রাসিয়েলার আবির্ভাব। গ্রাসিয়েলা কী? একটি পুরোনো হলুদ বাই-সাইকেল। এর সামনের ক্যারিয়ারে থাকত কিট ব্যাগ আর পেছনে দি মারিয়া। বোনকে নেওয়ার জন্য কাঠের সিট বানিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গ্রাসিয়েলায় চড়ে ছুটতে থাকে দি মারিয়ার স্বপ্ন।
শুরুর দিনগুলোতে তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না দি মারিয়া। ১৬ বছর বয়সেও তিনি জায়গা পাননি রোসারিও সেন্ত্রালের মূল দলে। জীবনের কষাঘাতে জর্জরিত বাবা তাই ছেলেকে ডেকে নেন ফুটবল ছেড়ে উপার্জনের পথ বেছে নিতে। এবারও আগলে রাখেন মা। আরেক বছর চেয়ে নেন ফুটবলে কিছু করার জন্য। সে বছরই দি মারিয়ার অভিষেক হয় সেন্ত্রালের জার্সিতে, শুরু হয়ে যায় স্বপ্নময় এক যাত্রার।
নাসিওনালের বিপক্ষে কোপা লিবার্তাদোরেসের ম্যাচ খেলতে তাদের যেতে হয় কলম্বিয়ায়। কিন্তু রোসারিওর বিমানবন্দর ছিল খুবই ছোট। যেখান থেকে উড়ত না কোনো যাত্রীবাহী বিমান। দি মারিয়ার তখন পরিচয় হারকিউলিসের সঙ্গে। হারকিউলিস কী? একটি কার্গো বিমান। কোনো উপায় না থাকায় অন্যান্য সব জিনিসের সঙ্গে সেই বিমানে চড়ে বসেন দি মারিয়া ও তার সতীর্থরা।
দি মারিয়ার জন্য হারকিউলিসের ওই যাত্রা ছিল অনেকটা ‘ওয়ান ওয়ে টিকেট’-র মতো। সেদিন প্রথম বিমানে চড়ার পর তার জীবনে আসতে থাকে একের পর এক উড়ান। ২০০৭ সালে প্রথম পান ইউরোপে খেলার প্রস্তাব। তাকে দলে ভেড়ায় পর্তুগালের ক্লাব বেনফিকা। কিন্তু নতুন ঠিকানায় শুরুটা প্রত্যাশামতো হয়নি তার। প্রথম দুই মৌসুমে তেমন খেলারই সুযোগ পাননি তরুণ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
এর মাঝেই আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি জেতেন ২০০৭ সালের অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্টে ৩ গোল করে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ে রাখেন বড় অবদান। এরপর ২০০৮ সালের অলিম্পিক দিয়েই শুরু দি মারিয়ার ‘ম্যান অব ফাইনাল’ হয়ে ওঠা। হুয়ান রোমান রিকেলমে, মেসি, সের্হিও আগুয়েরো, হাভিয়ের মাসচেরানোদের নিয়ে গড়া দলে দি মারিয়ার পা থেকে আসে স্বর্ণপদক জেতানো গোল।
এরপর ধীরে ধীরে সাফল্যের রাস্তা চিনে নেয় দি মারিয়ার ক্যারিয়ার। ২০১০ সালের জুনে তাকে দলে ভেড়ানোর ঘোষণা দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ক্লাবগুলোর একটি, রেয়াল মাদ্রিদ। তার পুরো পরিবারের জন্যই সেটি ছিল গর্বের এক মুহূর্ত। তার বাবা ও দাদাও খেলতেন ফুটবল। কিন্তু পেশাদার হয়ে ওঠার আগেই তারা পড়েন পায়ের চোটে। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় স্বপ্ন। সেটিই যেন পরে বাস্তবায়ন ঘটে দি মারিয়ার মাধ্যমে।
রেয়ালের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে নিজের প্রথম গোল করেন দি মারিয়া। প্রতিপক্ষ? হারকিউলিস ফুটবল ক্লাব। কাকতালীয় বটে। এভাবেই জীবনের একেকটি ঘটনার সঙ্গে মিশে গেছে দি মারিয়ার ফুটবল ক্যারিয়ার। রেয়ালের জার্সিতে একের পর এক জাদুকরী পারফরম্যান্সে মাদ্রিদ শহরের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।
২০১৩-১৪ মৌসুমে প্রায় এক যুগের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জেতে রেয়াল। রেয়ালের দশম ট্রফি ঘরে তোলার ম্যাচে কোনো গোল করতে পারেননি দি মারিয়া। কিন্তু মাঠজুড়ে দাপুটে পারফরম্যান্সে তিনিই জেতেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। সেদিন মেয়েকে কোলে নিয়ে ট্রফি হাতে হাস্যোজ্জ্বল ছবিটি দি মারিয়ার খুব প্রিয়। বছরখানেক আগে মাদ্রিদের এক হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়ছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু। তাই মেয়েকে নিয়ে শিরোপা উদযাপনে ঝরতে থাকে আনন্দাশ্রু।
ওই বছরই দেশের হয়ে বড় সাফল্যের দুয়ারে ছিলেন দি মারিয়া। কিন্তু পায়ের চোটে জার্মানির বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনাল তিনি খেলতে পারেননি। আগের ম্যাচগুলোতেও ব্যথানাশক নিয়ে খেলেন দি মারিয়া। একই প্রক্রিয়া সেরে ফাইনাল খেলতেও প্রস্তুত ছিলেন তিনি। আপত্তি জানায় রেয়াল, খেলাননি তখনকার কোচ আলেহান্দ্রো সাবেইয়া। ডাগআউটে বসেই দি মারিয়া হতে দেখেন স্বপ্নের সমাধি।
একই পরিণতি ঘটে পরের দুটি কোপা আমেরিকায়ও। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে পরপর দুই বছর চিলির বিপক্ষে ফাইনালে টাইব্রেকারে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। পরপর তিন ফাইনাল হারের ধাক্কায় আকস্মিক অবসরের সিদ্ধান্ত নেন মেসি। আর দি মারিয়াদের শুনতে হয় নানান সমালোচনা।
ক্লাব ফুটবলেও সময়টা এক পালাবদলের মধ্য দিয়ে কাটে দি মারিয়ার। ২০১৪ সালে তখনকার ব্রিটিশ রেকর্ড ৭ কোটি ৫৬ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফি-র বিনিময়ে ৫ বছরের জন্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নাম লেখান তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় বছরেই তাকে পিএসজির কাছে বিক্রি করে দেয় ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি।
ফ্রান্সের রাজধানী শহরের ক্লাবের হয়ে প্রথম মৌসুমেই ১৮টি অ্যাসিস্ট করে লিগ আঁ-র নতুন রেকর্ড গড়েন দি মারিয়া। পরে আরও ৬ বছর বেশ সফলতার সঙ্গেই পিএসজিতে খেলেন তিনি। ফ্রান্সে সাত বছর কাটিয়ে ইউভেন্তাসে নাম লেখানোর আগে পিএসজির হয়ে ২৯৫ ম্যাচে ৯২ গোলের সঙ্গে ক্লাব রেকর্ড ১৩৪ অ্যাসিস্ট করেন দি মারিয়া।
দেশের হয়ে তখনও ছিলেন দুর্দশার মাঝেই। ২০১৮ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে আর্জেন্টিনা। পরে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হেরে যায় তারা। তবু কোনোমতে পায় নক আউটের টিকেট। কিন্তু ফ্রান্সের বিপক্ষে পেরে ওঠেনি। ৪-৩ গোলের পরাজয়ে থেমে যায় আগের আসরের রানার্স-আপদের যাত্রা। পরের বছর কোপা আমেরিকায় তৃতীয় হয় আর্জেন্টিনা।
এরপর কোভিডের ধাক্কা লাগে বিশ্বজুড়ে। পিছিয়ে যায় ২০২০ কোপা আমেরিকা। ২০২১ সালে ব্রাজিল আসর দিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছরের গেরো খোলে আর্জেন্টিনা। ফাইনাল ম্যাচে স্বাগতিকদের ১-০ গোলে হারায় মেসির দল। গোলদাতা? আগুয়ান এদেরসনের মাথার ওপর দিয়ে করা চিপ শটে জাল খুঁজে নেওয়া দি মারিয়া। যেমনটা করেন ২০০৮ সালের অলিম্পিকস ফাইনালেও।
পরের বছর তখনকার ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালির সঙ্গে ফিনালিস্সিমায় ৩-০ গোলের সহজ জয় পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় গোলটি করেন দি মারিয়া। একইভাবে, আগুয়ান গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে আলতো চিপ শটে।
ওই বছরের ফিফা বিশ্বকাপেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটান দি মারিয়া। মেসির গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর ডাইভ দেওয়া উগো লরিসের শরীরের ওপর দিয়ে ম্যাচের দ্বিতীয় গোল করেন অভিজ্ঞ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
দুই গোলের লিড থাকা অবস্থায়ই দ্বিতীয়ার্ধে তাকে তুলে নেন লিওনেল স্কালোনি। এরপর তিন মিনিটের মধ্যে কিলিয়ান এমবাপের জোড়া গোলে ম্যাচে ফেরে ফ্রান্স। ডাগআউটে অঝোরে কাঁদতে থাকেন দি মারিয়া। হয়তো ফিরে আসছিল ২০১৪ বিশ্বকাপের স্মৃতি। সেদিনও যে বেঞ্চে বসেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটতে দেখেছিলেন তিনি।
তবে সেবার আর তেমন কিছু হয়নি। মেসির আরেকটি গোলের পর টাইব্রেকারে এমিলিয়ানো মার্তিনেসের বীরত্ব! দীর্ঘ ৩৬ বছর পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় তোলে আর্জেন্টিনা। আরও একবার ফাইনালে গোল করে নিজেকে এই সাফল্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেন দি মারিয়া।
বিশ্বকাপ জেতার পরই অবসর নিতে চেয়েছিলেন দি মারিয়া। মেসি তখন পরামর্শ দেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বেশে আরও কিছু দিন খেলে যাওয়ার। বন্ধুর কথা রেখে অবসরের ভাবনা দূরে ঠেলে দেন দি মারিয়া। তবে গত বছর জানিয়ে দেন, ২০২৪ কোপা আমেরিকার পর আর জাতীয় দলের হয়ে নামবেন না তিনি।
এবার মেসিও বুঝেছেন, প্রিয় ‘এল ফিদেও’র সিদ্ধান্ত আর বদলানো সম্ভব নয়। কানাডার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালের আগে তাই পুরো দলকে বলেন দি মারিয়ার জন্য ফাইনালে ওঠা নিশ্চিত করতে। আর শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনা অধিনায়ক টিম হোটেলে রাখেন প্রিয় বন্ধুর জন্য বিশেষ আয়োজন।
সব কিছু দেখে আরও একবার আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন দি মারিয়া। হয়তো মনে পড়ে যায় পেদ্রিয়েলে বাবার কয়লার ব্যবসা, মায়ের পেছনে ওঠা গ্রাসিয়েলা কিংবা হারকিউলিসে চড়ে প্রথম বিমান ভ্রমণের কথা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েই যে তিনি হয়ে উঠেছেন দি মারিয়া, হয়েছেন আর্জেন্টিনার কিংবদন্তিদের একজন।