ভুক্তভোগী কোনো কোনো পরিবারের কাছ থেকে কাজগপত্র নেওয়া হয়েছে। এখন ফোন করলে ‘এড়িয়ে যাচ্ছেন’ শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
Published : 30 Apr 2024, 02:14 AM
গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে হতাহতদের পরিবারকে সরকারের তরফে ক্ষতিপূরণের যে টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেটি পরে আর বিতরণ করা হয়নি।
সেই দুর্ঘটনায় যে ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি ছিলেন পরিবারের আয়ের প্রধান বা একমাত্র অবলম্বন। প্রিয় মানুষটির পাশাপাশি নিয়মিত আয়ের প্রবাহ হারানো পরিবারগুলোর অসহায় অবস্থায় পড়েছে।
গত বছরের ৭ মার্চের সেই বিস্ফোরণের পর শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ এবং আহতদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার করে টাকা দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল।
একাধিক পরিবারকে ফোন করে কাগজপত্রও নেওয়া হয়। কিন্তু পরে তাদেরকে আর কিছুই জানানো হয়নি। তারা ফোন করেও কোনো সদুত্তর পাননি।
একটি ভুক্তভোগী পরিবারের এক সদস্যের ধারণা, তাদেরকে যে টাকা দেওয়ার কথা ছিল, সেটি হয়তো আত্মসাৎ করা হয়ে থাকতে পারে।
কেন এমন হল, সে বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে সদুত্তর মেলেনি। প্রশ্নের জবাব দিতে ‘কাল-পরশু করে’ শেষ পর্যন্ত একজন আরেকজনকে কল করতে বলেন।
অথচ শ্রম মন্ত্রণালয়ের সে সময়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যম কর্মীদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, যারা মারা গেছে, তাদের স্বজনদের দুই লাখ করে এবং আহতদের ৫০ হাজার করে টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আকতারুল বদলি হয়ে গেছেন। তার জায়গায় দায়িত্বে আসা এ কে এম ফেরদৌস বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।”
পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম মন্ত্রণালয়ের যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের সবাই বলেছেন একই ধরনের কথা।
কী জানল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
২০২৩ সালের ৭ মার্চ বিকালে রাজধানীর নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাত তলা ক্যাফে কুইন ভবনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটলে চারপাশ ধোঁয়া আর ধুলায় ঢেকে যায়। বিস্ফোরণে ওই ভবনের দুটি ফ্লোর ভেঙে নিচে পড়ে যায়। ভবনের ২৪টি কলামের মধ্যে ৯টি কলাম, স্ল্যাব বিমসহ রিটেইনিং ওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফুলবাড়িয়ায় বিআরটিসি বাস টার্মিনালের শ খানেক গজ দক্ষিণে সদরঘাটমুখী সড়কের পাশের ওই ভবনে স্যানিটারি সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অফিসও ছিল। ভবনের ওপরের কয়েকটি তলায় ছিল আবাসিক ফ্ল্যাট।
সেই বিস্ফোরণে ভবনে থাকা বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীদের পাশাপাশি সামনে রাস্তায় থাকা যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরাও হতাহত হন। ঘটনার দিনই বিস্ফোরণের ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
পরের কয়েক দিনের তল্লাশিতে পাওয়া মরদেহ এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকজনের মৃত্যুতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয় ২৬ জন।
সেই ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে একই পরিবারের সদস্য আছেন একাধিক। একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী, দুটি পরিবারের দুই ভাই, একটি পরিবারের দুই খালাতো ভাই মারা গেছেন। ফলে পরিবারের সংখ্যা ২২টি।
এর মধ্যে আটটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। মরদেহ হস্তান্তরের সময় সমাহিত করার খরচ বাবদ ৫০ হাজার টাকাই কেবল পেয়েছেন তারা। পরে আর কোনো টাকা পাননি বলে জানিয়েছেন।
এই আট পরিবারের মধ্যে দুটি পরিবার শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ফোন পেয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু বিষয়টি আর আগায়নি। তারা ফোন করে যোগাযোগ করার পর ‘ব্যস্ত আছি’, ‘পরে ফোন করেন’, এসব কথা বলা হয়।
অন্য পাঁচটি পরিবারকে ফোনও করা হয়নি।
‘সব কাগজপত্র নিল, এরপর ঠান্ডা হয়ে গেল’
সেই বিস্ফোরণে বাবা মমিনুল ইসলাম ও মা নদী বেগমকে হারিয়ে তাদের ১৫ বছর বয়সী ছেলে এবং ১২ বছর বয়সী মেয়ে এখন অনাথ। তাদের বাড়ি চকবাজারের ইসলামবাগ এলাকায়। এখন বৃদ্ধ দাদা-দাদির আশ্রয়ে আছে দুই শিশু।
তাদের চাচা জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মমিনুল সিসি ক্যামেরার ব্যবসা করতেন। আর ঘর ভাড়ার আয়ে সংসার চলে যেত। এখন জীবন তাদের কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ শিশু দুটির দাদা-দাদিরও বয়স হয়ে গেছে।
এই দম্পতির জন্য তাৎক্ষণিক এক লাখ টাকা অনুদানের বাইরে ২০২৩ সালের ৯ মার্চ শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আরও কিছু কাগজপত্র তৈরি রাখতে বলা হয়। জানানো হয়, দুই লাখ করে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে।
এরপর কী হয়েছে? এই প্রশ্নে ১৩ মাস পর জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা মহিলা সব কাগজপত্র নিল। রাত ১১টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত তার আছে আমরা ছিলাম। পরে উনি ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, “বহুবার ফোন দিয়েছি। বলে ‘আমি ব্যস্ত আছি’, আবার বলে, ‘বড় স্যার আছে’, আর কী কী যেন বলে।”
জয়নালের ভাষ্য, সেই বিস্ফোরণে নিহত আরও একটি পরিবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে। সব কাগজপত্র নেওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগ করেনি, টাকাও দেয়নি।
জালিয়াতির সন্দেহ
নিহত মুনসুর হোসেনের একটি ছোট সন্তান আছে। তাকে নিয়ে স্ত্রী মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বলে জানালেন মনসুরের ভায়রা মুরাদ হোসেন মিলন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মানুষের অসহায়ত্ব দেখেছি। কিন্তু ছোট সন্তান নিয়ে এমন অসহায় হয়ে পড়েছে তার স্ত্রী, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ঈদে আমরা এতিম সন্তানকে কিছু টাকা দেই, তাতে কি আর জীবনে চলে?”
মুরাদের সন্দেহ, ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে ‘নয় ছয়’ হয়েছে।
তিনি বলেন, “শ্রম মন্ত্রণালয়ে এই কাজে যারা জড়িত আছে সবাই জালিয়াতি করেছে। নইলে ঘোষণা দেওয়ার পরেও কোনো পরিবারই একটি টাকাও পায়নি কেন?
“আমরা সেখানে বাজার কমিটির পক্ষ থেকে বহুবার গেছি, বহুবার বলা হইছে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয় নাই। তারা শুধু বিষয়টা এড়িয়ে গেছে। এই মন্ত্রণালয়ের ভালো কিছু দেখলাম না। শ্রমিকদের জন্য এই কাজটুকুই স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে পারল না। এই টাকা যদি আসলেই বরাদ্দ হয়ে থাকে এবং নিহতের পরিবার যেহেতু পায়নি, এই টাকা তারা ভাগাভাগি করে খেয়েছে।”
‘কোথায় গিয়ে খোঁজ করব?’
আজাদ সেনিটারি নামে একটি দোকানের ভ্যানচালক হিসেবে কাজ করতেন প্রাণ হারানো ইদ্রিস মীর। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মো. রিফাত কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। ছোট ছেলের এখনও সব কিছু বোঝার বয়স হয়নি। কেবল দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে।
বাবার মৃত্যুর পর রিফাত স্নাতকে ভর্তি হলেও কলেজে যেতে পারছে না। যাত্রাবাড়ীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন।
এক বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত খবর থেকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়ের কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
বাবার মৃত্যুর পর অথৈ সাগরে পড়ে যাওয়া পরিবারটির ভার এসে পড়ে রিফাতের অপ্রস্তুত কাঁধে। গত এক বছরে বহুবার ফোন করেছেন, জানতে চেয়েছেন সেই টাকাটার কোনো সুরাহা হল কি না।
এক বছর পরে এসে রিফাত বললেন, আজও তিনি অপেক্ষায়?
মন্ত্রণালয়ে খোঁজ করেছিলেন কি না জানতে চাইলে রিফাত বললেন, “না, কোথায় গিয়ে খোঁজ করব?”
তাহলে কোনো চেষ্টাই করেননি? রিফাত বললেন, “মার্কেট মালিক সমিতির কাছে গিয়েছিলাম। তারা ৩০ হাজার টাকা দিল। আর বলছে, একটা লিস্ট করছে, দুই চার মাস বা এক বছরের মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে টাকা পাব। কিন্তু আর তো পাইনি।”
সমিতির সঙ্গে আর যোগাযোগ করেছিলেন কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “কল করেছিলাম। তারা বলে, ‘আমরা কী বলব?’।”
বিস্ফোরণে নিহত ইসহাক মৃধার ফুফাতো ভাই হুমায়ুন কবির খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাফনের কাজ সম্পন্ন করতে সেই সময়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিল। এরপর ১৫-২০ দিন পরে শ্রম মন্ত্রণালয়ে থেকে ফোন করে বলেছিল দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। পরে আর তারা খোঁজ নেয়নি।”
কোথাও যোগাযোগ করেছিলেন কি না, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোথায় আবেদন করব? আমাদের তো কোথাও কেউ আবেদনও করতে বলে নাই।”
ইসহাক মৃধার পরিবারে রয়েছে স্ত্রী ও দুই সন্তান। বড় ছেলের বয়স ৮ বছর। সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। দুই ছেলে নিয়ে ইসহাকের রেখে যাওয়া অল্প সঞ্চয় থেকে খরচ করে তারা জীবন-যাপন করছেন।
তাদেরকে কেউ ফোনও করেনি
একটি ছোট কারখানার মালিক মো. ইসমাইলের পরিবার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো ফোনও পাননি। স্বজনদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো ধারণাও নেই।
ইসমাইলের ভাই আব্দুল কুদ্দুস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ পেয়েছে কিনা বা টাকা দেওয়ার বিষয়ে তো কিছুই জানি না। আমার ভাই মারা যাওয়ার দুই বছর আগে বাবা মারা গেছেন। আমার ভাই ছিল আমাদের পরিবারের বটগাছ। এরপর পরিবারের হাল আমাকে ধরতে হয়েছে।”
পরিবারটি এখন কীভাবে চলছে, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভাই চারটি ছোট ছোট ছেলে রেখে মারা গেছেন। বড় ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, বাকিরা স্কুলে।
“এই ছোট ছোট সন্তান নিয়ে ভাবি খুবই অসহায় অবস্থায় আছে। টাকা পেলে এই সন্তানগুলোর জন্য অনেক ভালো হত।”
সিদ্দিক বাজারে পণ্য কিনতে গিয়ে ওই বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় বিবিএ শিক্ষার্থী আল আমিন। তার ভাই হাবিবুর রহমান পত্রিকায় ক্ষতিপূরণের খবর পড়ার পর ভেবেছিলেন ফোন পাবেন। কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।
একটা দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন রাহাত হোসেন । দোকানের মালিকের একটা পার্সেল আনতে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে গিয়েছিলেন তিনি। আর ফেরেননি। বিস্ফোরণের কথা জানার পর স্বজনরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তার মরদেহ পাননি। পরে ঢাকা মেডিকেল মর্গে গিয়ে লাশ সনাক্ত করেন রাহাতের ভাই রাকিবুল হাসান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রম মন্ত্রণালয়ের থেকে আমরা কোনো টাকা পাইনি।”
ওই ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি গ্রামের দুই ভাই আবু জাফর সিদ্দিক তারেক ও আওলাদ হোসেন মুসারও প্রাণ গেছে।
তাদের মধ্যে জাফর মারা গেছেন ঘটনাস্থলে। পরদিন মুসা মারা যান হাসপাতালে। তারা দুই ভাই বাড়ির স্যানিটারি মালামাল কিনতে ওই মার্কেটে গিয়েছিলেন।
দু্ই ভাইয়ের বাবা মারা গেছেন আগেই। তাদের মা জীবন সায়াহ্নে এসে একসঙ্গে দুই সন্তান হারানোর ধাক্কা পেলেন। তার এক ছেলে আর এক মেয়ে আছেন। কিন্তু সংসারে আয় করার মত কেউ নেই।
তাদের খালাত ভাই রাশেদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিদ্দিকের দাফন বাবদ সেদিনই ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি, আর মুসার টাকা পেয়েছি ১৫ দিন পরে। আর আমরা জানতাম না ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লক্ষ করে টাকা দেওয়ার কথা। এমনকি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকেও ফোন পাইনি।”
মন্ত্রণালয়ের কেউ জানে না
কাউকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়নি কেন– এই প্রশ্নে শ্রম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “আমি নতুন যোগদান করেছি তাই, এ ব্যাপারে জানি না।”
তার পরামর্শে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হাজেরা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই।
হাজেরার পরামর্শে এরপর যোগাযোগ করা হয় আরেক যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন সরকারের সঙ্গে। তারও সেই একই কথা।
হোসেন সরকার পরামর্শ দিলেন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মোল্লাহ জালাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
মোল্লাহ জালালের কাছ থেকেও জানা গেল না কোনো তথ্য। তিনি বলেন, “কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ইনস্পেক্টর জেনারেল মো. আব্দুর রহিম খানের সঙ্গে কথা বলুন।”
আব্দুর রহিম খান বলেন, “আমিও এখন বলতে পারছি না। পরে দেখে বলতে হবে।”
পরে তিনি আবার মোল্লাহ জালাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন, যিনি কিছুই বলতে পারেননি।
ক্ষতিপূরণ কি দুই লাখ টাকা হওয়া উচিত?
শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মস্থল দুর্ঘটনায় মারা গেলে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা বলে জানিয়েছেন ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী এ কিউ এম কাদের। তিনি লেবার কোর্টেও প্র্যাকটিস করেন।
তিনি বলেন, পাঁচ লাখের মধ্যে সরকারের দেওয়ার কথা দুই লাখ টাকা, দুই লাখ টাকা বীমা কোম্পানির এবং কারখানা মালিকের এক লাখ টাকা। তবে এই ক্ষতিপূরণ পাবে কেবল শ্রমিকরা।
বাংলাদেশে কারখানা বা ভবন মালিকরা এই বীমা করেন না। ফলে দুই লাখ টাকা পাওয়া যায় না বললেই চলে। আর ভবন মালিকের পক্ষ থেকে এক এক লাখ টাকা পাওয়ার কথা আইনে আছে, সেটা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে না এ ক্ষেত্রে।
সিদ্দিক বাজারের যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের সবাই দোকান কর্মচারী নন। আবার কেউ কেউ দোকানে কাজ করলেও সবার নিয়োগপত্র অথবা পরিচয়পত্র ছিল না।
যেমন ইদ্রিস মীর। তিনি কয়েকটি দোকানের মালামাল পরিবহন করতেন।
তার ক্ষেত্রে কী হবে? আইনজীবী কাদের বলেন, “এদেরকে বলা হয় লোডার। তাদের পরিচয়পত্র থাকে না সব সময়। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বোঝা যায়। আবেদন করলে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদেরকে ক্ষতিপূরণের আওতায় রাখা হয়।”
কোথায় আবেদন করতে হবে, সেই প্রশ্নে তিনি শ্রম অধিদপ্তরে নোটিস দেওয়া বা শ্রম মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগে আবেদন করার পরামর্শ দেন। এই বিভাগের কাজ চলে সচিবালয়ে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সালের কাছে নিহতদের জন্য ঘোষিত ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিদ্দিক বাজারের যে ঘটনা ঘটেছিল, এমন ঘটনা দেশে প্রচুর ঘটছে। এই রকম ঘটনা লাগাতার ঘটতে দেওয়া যায় না। কারণ মানুষ মারা যাচ্ছে আর পরিবারগুলো অসহায় হয়ে যাচ্ছে।
“এখানে সরকারি যে সহায়তা তা যদি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকে এবং পরে না দেওয়া হয়, তাহলে যারা অলরেডি ক্ষতিগ্রস্ত, তারা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে যে আইন আছে তা যদি সঠিকভাবে না মানা হয়, তাহলে সেই আইনের প্রতি জনগণের অনাস্থা তৈরি হয়। কাজেই জনগণকে ক্ষেপিয়ে কোনো কিছুই চলতে পারে না।”
আটকে আছে মামলার তদন্ত
গ্যাস লাইন থেকে সূত্রপাত হওয়া ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি এক বছরেও। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের বম ডিসপোজাল ইউনিটের পরিদর্শক এস এম রায়সুল ইসলাম বলছেন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ‘অসহযোগিতায়’ ঝুলে আছে তদন্ত।
গত বছর ৭ মার্চ বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়। ৮ মার্চ ভবন মালিক দুই ভাই ওয়াহিদুর রহমান (৪৭) ও মতিউর রহমানের (৩৬) সঙ্গে ভবনের বেজমেন্টের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আবদুল মোতালেব মিন্টুকে (৩৭) আটক করা হয়।
এরপর ৯ মার্চ বংশাল থানার এসআই পলাশ সাহা বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। সেদিনই তাদেরকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
১৪ মার্চ আটক তিনজনকে ‘দায়িত্বে অবহেলাজনিত মৃত্যু’র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রেপ্তার তিনজন জামিন পেয়ে যান। এখনও তারা জামিনে রয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস এম রায়সুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “গ্যাস লাইন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এটি এক সময় টিনশেড ভবন ছিল। তখন একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। সে সময় জায়গার মালিক, যিনি এখন মৃত (বর্তমান মালিক ওয়াহিদুর রহমান ও মতিউর রহমানের বাবা) ওই রেস্টুরেন্টের জন্য একটি বাণিজ্যিক গ্যাস লাইন নিয়েছিলেন।
“পরে টিনশেড ভবনটি ভেঙে পাঁচ তলা ভবন করা হয়। ওই ভবনের নিচ তলায় ক্যাফে কুইন রেস্টুরেন্ট ছিল। তখনো সেখানে বাণিজ্যিক গ্যাস লাইন ছিল। এক পর্যায়ে রেস্টুরেন্টটি তুলে দিয়ে সেখানে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়। তখন বাণিজ্যিক গ্যাস লাইন সারেন্ডার করে সেখানে আবাসিক গ্যাস লাইন সংযোগের অনুমতি নেওয়া হয়।”
রায়সুল ইসলাম বলেন, তৎকালীন বাড়ির মালিক তিতাস গ্যাসকে আবাসিক লাইনের সংযোগ দেওয়ার কথা বললে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে গ্যাসের লাইন পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু তিতাস গ্যাসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গ্যাসের পাইপলাইন আগেরটা ঠিক রেখে আবাসিক লাইনের গ্যাস সংযোগ চালু করে।
“আবাসিক লাইনের গ্যাস পাইপ ও কমার্শিয়াল লাইনের গ্যাস পাইপের চলাচলের গতি ভিন্ন। মূলত গ্যাস লাইনের পাইপ পরিবর্তন না করায় দীর্ঘদিন পর এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে তিতাস গ্যাস ও তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই দুর্ঘটনার জন্য অনেকটাই দায়ী।”
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তিতাস গ্যাসকে চিঠি দিয়ে ওই সময়কার (২০০২ সালে) যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক গ্যাস লাইনের পরিবর্তে আবাসিক লাইনের সংযোগ দিয়েছিল সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিতাস গ্যাস ওই নাম দিতে পারেনি।
পরে আদালত তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে নির্দেশ দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য জানাতে। কিন্তু এখনও তিতাস তথ্য জানাতে পারেনি।
তদন্ত কর্মকর্তা এস এম রায়সুল ইসলাম বলেন, “তিতাস গ্যাস ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ওই সময়ে তিতাস গ্যাসে যারা কর্মরত ছিলেন তাদের তথ্য জানানোর পর বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা যাবে এবং দ্রুত তদন্ত শেষ করা সম্ভব হবে। আর তখনই এ মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে।”
পুরনো খবর:
সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণ: বাবাহারা মাহাদী এ কোন দোটানায়
'মানুষ উড়ে এসে পড়েছিল রাস্তায়, গাড়ির ওপরও'
সিদ্দিক বাজার বিস্ফোরণ: ক্ষতিপূরণের ফোন কেউ কেউ পাচ্ছে, অন্যরা অপেক্ষায়