ছেলেকে বাবা বলে গেছেন, তার মৃত্যুর পর যেন তার স্ত্রীর হাত পাততে না হয়। কিন্তু সহায়তা ছাড়া সংসার চলবে না। সরকার যে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে, সে সম্পর্কেও নেই ধারণা।
Published : 21 Mar 2023, 11:49 AM
মানিকগঞ্জের ওবায়দুল হাসান বাবুলের জীবনে কেবলই দুর্যোগের আঘাত। নদী ভাঙনে গেছে ঘরবাড়ি। ‘উদ্বাস্তু হয়ে’ পরিবার চালাতে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু পরিবারের ভাগ্য পাল্টায়নি। উল্টো থেমে গেল জীবনের চাকা।
গত ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে যে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণ হয়, তাতে প্রাণ হারান বাবুলও।
বাবুলের এই চলে যাওয়ায় তার স্ত্রী, সন্তানের জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত, বিপন্ন।
ধার্মিক এই মানুষটি তার ছেলের কাছে আগেই অছিয়ত (ইচ্ছার প্রকাশ) করে গেছেন, তার মৃত্যুর পর যেন স্ত্রীকে হাত পাততে না হয়। এ কারণে মাদ্রাসায় পড়ুয়া তার কিশোর ছেলে মাহাদী হাসান পড়েছে উভয় সংকটে।
উপার্জন করার মত পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি তার। কিন্তু বাবার বন্ধু, ভাইরা সহায়তার যে আশ্বাস দিয়েছেন, নিতে পারছে না তাও।
শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিহতদের স্বজনদেরকে দুই লাখ টাকা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই টাকা পরিবারটির অনিশ্চয়তা কিছুটা হলেও দূর করতে পারত। ওই টাকাটা পেলে বাবার রেখে যাওয়া একখণ্ড জমি চাষ করে কিছু আয় হতে পারত মাহাদীদের পরিবারের। চার বছরের মধ্যে মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস কোর্স শেষ হয়ে গেলে চাকরিও হয়ে যেতে পারত কোথাও।
তবে সহায়তার ওই টাকার বিষয়ে কোনো ধারণা নেই মাহাদীদের পরিবারের। কেউ ফোন দেয়নি। যদিও মন্ত্রণায়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “যাদের নাম তালিকায় আছে, তাদের সবার স্বজন পাবেন ধীরে ধীরে।”
বাবুলের মরদেহ নিয়ে আসার সময় মিলেছে ৫০ হাজার টাকা অনুদান। সমাহিত করার খরচ বাদ দিয়ে এই টাকাটা এখন বড় অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাবুলের স্ত্রী নাজমান আক্তার বলেন, “আমার পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন তিনি (বাবুল)। এখন পরিবার কীভাবে চলবে শুধু আল্লাহ জানেন।
“তার স্বপ্ন ছিল ছেলে মাওলানা হবে। তাই মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে সে। তার পড়াশোনাই বা শেষ হবে কীভাবে! আল্লাহ সব শেষ করে দিয়েছেন।”
স্থানীয় জামিয়া আরাবিয়া সিদ্দিকিয়া উলুম মাদ্রাসায় পড়ে মাহাদী। সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাসিদ পেতে পড়াশোনা করতে হবে আরও চার বছর। এর পাশাপাশি মানিকগঞ্জ ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে।
বাবুলের প্রতিবেশী মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবারের আয় বাবুল ভাই করতেন। এখন সংসার চলবে কীভাবে আমরা জানি না। উনার পরিবারের জন্য সরকারি সহায়তা জরুরি।”
মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু মোহাম্মদ নাহিদ বলেন, “আমরা সামাজিকভাবে এবং পৌরসভার পক্ষ থেকে কিছু করার চেষ্টা করব যেন তার ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে সরকারি দপ্তরগুলোকেও সহায়তার জন্যও অনুরোধ করছি।”
উভয় সংকটে ছেলে
মাহাদী বিডিনিউজ টোয়েন্টেফোর ডটকমকে বলে, “আব্বুর ওছিয়ত ছিল। বলেছিলেন, ‘যদি আমি মারা যাই, তোমার আম্মার যেন হাত না পাততে হয়’।
“আবার আব্বু মারা যাওয়ার পর আমার পীর চাচারা (দরবার শরিফের মুরিদ) অনেকেই বলেছেন, ‘আপন মনে কইরা আমার কাছে চাইবা’, আমার চাচা বলেছেন, ‘তোমার কোনো চিন্তা নাই’। কিন্তু আমি এখন কী করব?”
বাবার শেষ ইচ্ছা, নাকি অনিশ্চিত জীবনে বাড়িয়ে দেওয়া হাত, কোনটা টেনে নেবেন, সেই দোটানায় পড়া এই কিশোরের সামনে কঠোর ‘বাস্তবতা’।
“আব্বু মারা গেছে। এখন আবেগের বশে অনেকেই অনেক কিছু বলবে। কিন্তু আমার পড়াশোনা শেষ করতে আরও চার বছর লাগবে। এতদিন কে টানবে? দেখা যাবে, যখন আমার দরকার, তখন কৌশলে হাত গুটিয়ে নেবে। এটাই বাস্তব।”
এই দোটানার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষকদের ওপর ভরসা করছে মাহাদী।
“আমাদের কওমি মাদ্রাসায় তো প্রাইভেট পড়ানোর সিস্টেম নেই। তবে হুজুররা বলেছেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত আমাকে ছুটি দেবে। সে সময় প্রাইভেটও খুঁজে দেবেন।
“আবার আমার আব্বু একটা জমি লিজ নিয়ে তাতে চাষাবাদ করত। সেখানেও টাকা পয়সা হলে কিছু করব ভাবছি। আম্মু যদিও এখন বলছেন, ‘তোমার কিছু করতে হবে না।’
“এখন এই সময়ে এ নিয়ে আর কথা বাড়াইনি। কিন্তু কিছু তো করতে হবে।”
ক্যাফে কুইন ভবনে কেন গেলেন বাবুল?
মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার চর বেউথা গ্রামে এখন মাহাদীদের আবাস। তবে একসময় বাড়ি ছিল হরিরামপুর উপজেলায়। পদ্মার ভাঙনে বাড়ি বিলীন হয়ে গেলে এখানে এসে আশ্রয় নেন।
বাবুল কাজ করতেন একটি প্রিন্টিং প্রেসে। পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার এলাকার সেই প্রেস। সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ি যেতেন।
তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ দরবার শরিফের মুরিদ। ঢাকায় তার মত মুরিদ আছেন আরও। দরবার শরিফের একটি শাখা ছিল টাঙ্গাইলে। শবে বরাতের পরদিন সেখানে ছিল মাহফিল। ঢাকা থেকে একসঙ্গে আট জন যাওয়ার কথা ছিল।
পকেটে ট্রেনের আটটি টিকিট নিয়ে ক্যাফে কুইন ভবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল বাশারের হার্ডওয়্যারের দোকানে গিয়েছিলেন বাবুল।
মাহাদী জানান, তার বাবাকে দোকানে বসিয়ে আবুল বাশার যান ‘ফ্রেশ হতে’, দোকানের কর্মীরা যান গুদামে। তারা যেতেই হয় বিস্ফোরণ। আর ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান বাবুল।