জেলা প্রশাসক বলেছেন, “গত রাতের বৃষ্টিতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছ চাষিরা। এ ছাড়া অনেক ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে।”
Published : 06 Oct 2023, 05:31 PM
টানা বর্ষণে তলিয়েছে ময়মনসিংহ নগরীর বেশিরভাগ রাস্তাঘাট। হাঁটু থেকে কোমড় পানির মধ্যে রাতভর চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি জেলায় টানা বৃষ্টি হয়। সকালে অনেক স্থান থেকে পানি নেমে গেলেও শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত শহরের কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
এর মধ্যে মধ্যরাতে নগরীর ব্রাহ্মপল্লী এলাকার বাসায় হাঁটু পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন মো. পলি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধা। তিনি ঘরেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন বলে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শাহ কামাল আকন্দ জানান।
স্থানীয়রা জানান, টানা বৃষ্টিতে নগরীর গাঙ্গিনারপাড়, ধোপাখোলা, চরপাড়া, নতুন বাজার, স্টেশন রোড, নয়াপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, কালীবাড়ি, গুলকিবাড়ি, আমলাপাড়া, ভাটিকাশরসহ নগরীর অনেক এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে।
এসব এলাকার বাসাবাড়ি দোকানপাট, মসজিদ, মাদ্রাসা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠে যায়। অনেককে পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। শুক্রবার সকালের মধ্যে বেশকিছু এলাকার পানি নেমে গেলেও সানকিপাড়া, গুলকিবাড়ী, কপিক্ষেত, আকুয়া, ভাটিকাশরসহ বেশ কিছু এলাকায় বিকালে পর্যন্তও পানি জমে থাকতে দেখা যায়।
সানকিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আসাদ জামান বলেন, “আমার ৪০ বছরে এমন বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা কখনও দেখিনি। এলাকার প্রত্যেকটা বাসায় পানি উঠে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কমপক্ষে ১৫ দিন আমাদের এর রেশ টানতে হবে। বৃষ্টি না হলে দুইদিনের মধ্যে পানি সরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
একই এলাকার নুসরাত জাহান বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বাসায় হাঁটু পানি জমে। পরে পরিবারের সবাই আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। শহরের প্রত্যেকটা রাস্তাঘাট পানিতে ভরপুর। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় আমাদের দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না।”
ভাটিকাশর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, “সামান্য বৃষ্টিতেই আমাদের এই এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। আমাদের এলাকার পানি সরতে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে, যদি এরমধ্যে বৃষ্টি না হয়।”
অটোরিকশার চালক হামিদ মিয়া বলেন, “টানা বৃষ্টির কারণে দুইদিন ধরে কোনো আয় নেই। পানির মধ্যে পেটের ক্ষুধা নিয়ে বের হয়ে বিপাকে পড়েছি। মনে হচ্ছে, রিকশার ব্যাটারি একটি নষ্ট হয়ে গেছে।”
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, হাসপাতাল চত্বরের কিছু এলাকা নিচু হওয়ায় পানি ঢুকে পড়েছে। স্টাফ কোয়ার্টারগুলোর নিচতলা পানিতে তলিয়ে গেছে।
“গত রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে চিকিৎসা সেবা চালু রাখা ছিল। তবে, সকাল থেকে বিকল্প বিদ্যুৎ লাইনে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের ময়মনসিংহ অঞ্চলের সহকারী প্রকৌশলী আকরাম আলী বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে রেলপথ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিগন্যাল পয়েন্ট কাজ করছিল না। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছিল।”
টানা বৃষ্টিতে রাতে নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার পাওয়ার গ্রিডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পানি উঠে যায়। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তিন ঘণ্টার চেষ্টায় সেই পানি নিষ্কাশন করে। এতে বেশ কিছু এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল বলে জানান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ময়মনসিংহের দক্ষিণ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর এলাকার বাসিন্দা রুকন উদ্দিন বলেন, “টানা বর্ষণে আমার ১০ কাটা ধান ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। পানি দ্রুত না কমলে ক্ষেতে ধান পচে যাবে।”
সদর উপজেলার চরহরিপুর এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, “১০ শতাংশের পুকুর ডুবে সব মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, জেলার সব উপজেলায় অনেক ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে, কী পরিমাণ ধান ক্ষেত তলিয়েছে তার কোনো হিসাব এখনও করা হয়নি। পানি নেমে গেলে হিসাব করা যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, “নগরীতে এখন রাস্তার চেয়ে ড্রেন উঁচু করে নির্মাণ করা হচ্ছে। যার কারণে ভারী বৃষ্টি হলেই ড্রেনের পানি প্রথমে রাস্তায় পরে বাসায় গিয়ে ঢুকে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রেনেজ ব্যবস্থা না করলে নগরবাসীকে আরও চরম মূল্য দিতে হবে।”
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, “এত বৃষ্টি আমার জীবনেও দেখিনি। খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন সঠিকভাবে না হওয়ায় নগরীতে জলাবদ্ধতা বেশি হয়েছে। যেসব এলাকায় এখনও পানি জমে আছে সেসব এলাকার ভোগান্তি নিরসন করতে সিটি করপোরেশন কাজ করছে। সিটি করপোরেশনের চলমান ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ সম্পন্ন হলে মানুষ জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে।”
জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, “গত রাতের বৃষ্টিতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছ চাষিরা। খামারিদের ফিসারি মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়া প্রতি উপজেলায় অনেক ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির এখনও সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে, হিসাব সংগ্রহ করছি। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”