“কীসের ঈদ? এখন চাই আমার স্বামী ভালোমত যেন ফিরে আসে।”
Published : 11 Apr 2024, 12:27 PM
নাবিক তারেকুল ইসলামের ঈদ সমুদ্রে কাটলেও ভিডিও কলে জাহাজে ঈদ কেমন সে গল্প শোনাত মাকে। সন্তান কাছে না থাকলেও ওইটুকু সান্ত্বনা নিয়েই গোটা উৎসব কেটে যেত মায়ের।
আর ২৭ বছরের টগবগে তরুণ নাবিক মো. আনোয়ারুল হক রাজুর নতুন জীবন শুরু করার কথা; তাই তার বাড়িতে নতুন ঘর তৈরির কাজ চলছে। গত বছর ভাইয়ের সঙ্গে উৎসবের দিনের কথা মনে পড়ে নাবিক আতিক উল্লাহ খানের ভাইয়ের।
সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর এসব নাবিকদের পরিবার আর স্বজনদের কাছে ঈদের কোনো আনন্দ নেই। ঈদের সকালে সবাই যখন উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা; তখন জিম্মিদের পরিবারের প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর শঙ্কায়। টুকরো টুকরো গল্পে পুরানো স্মৃতিরা তাজা হয় তাদের চোখের জলে।
সকালটা ঈদের হলেও কোনো হৈ-হুল্লোর নেই ফরিদপুরের রায়পুর ইউনিয়নের ছকড়িকান্দি গ্রামে নাবিক এন মোহাম্মদ তারেকুলের বাড়িতে; তিনি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের থার্ড অফিসার। অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির সংবাদ আর তাকে ফিরে পাওযার আশায় কাটছে তারেকুলের মা, বাবা, স্ত্রী আর সন্তানের।
আড়াই বছরের নাতনিকে নিয়ে ঈদগাহ থেকে ফেরার পথে কথা হয় তারেকুলের বাবা মো. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। ছেলে কাছে নেই, নাতনিকে বুকে আগলে ধরে বলেন, “গেছিলাম নামাজ পড়তে। ছেলের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছি। ঘরেও সাদামাটা আয়োজন। আসলে মনমানসিকতা ভালো না।
“গত বছরের ঈদেও ছেলে সমুদ্রে ছিল; আর এবার তো সে বন্দি। সামনে কী আছে আল্লাহই জানে।”
গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়লা নিয়ে যাওয়ার পথে সোমালিয়ান উপকুল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জিম্মি করে জাহাজের ২৩ নাবিককে।
জিম্মি করার আটদিনের মাথায় ২০ মার্চ জলদস্যুরা তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে জাহাজ মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মালিকপক্ষ তৃতীয় ওই পক্ষের মাধ্যমে দফায় দফায় আলোচনা চালাচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে তারা জানিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী মো. দেলোয়ার হোসেনের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তারেকুল। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল থেকে পাস করে তিনি চলে যান ঢাকায়। সেখানে মিরপুরের ড. মো. শহীদুল্লাহ্ কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন।
এরপর ২০১২ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে। ২০১৪ সালে নটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরিতে যোগ দেন। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে নতুন করে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর থার্ড অফিসার হিসেবে।
তারেকুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, “সাত বছর বয়স থেকে কখনও নামাজ-রোজা কামাই করেনি তারেক। গতবারও ঈদের নামাজ জাহাজে পড়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে। ঈদের দিনও ফোনে সবার সঙ্গে কথা বলেছে।
“বাড়িতে ঈদ করতে না পারলে ভিডিও কল করে জাহাজে ঈদে কেমন কেটেছে সে গল্প শোনাত আমাকে। সরকারের কাছে আমার আবেদন, আমার ছেলেসহ বন্দি সবাইকে যেন ছাড়িয়ে আনে।”
হাসিনা বেগমের কথা শেষ হতেই দেলোয়ার হোসেন বলেন, “প্রতিবছর তো ছেলেরাই ঈদের কেনাকাটা করে দেয়। এবার কিছুই হয়নি আমাদের। এখন শুধু ছেলের সুস্থতা আর নিরাপদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি।”
ছেলের কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে দেলোয়ারের; ভিজে ওঠে চোখের কোণ। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন, “দস্যুরা কথায় কথায় মাথায় বন্দুক ধরে; তারওপর জাহাজে খাবার সংকট, পানি সংকট। এ রকম নানা দুশ্চিন্তায় আছি। প্রশাসনসহ অনেকেই আমাদের খোঁজ নিতে আসে। শুধু সান্ত্বনা দিয়েই যায়; সন্তানের ভালো সংবাদ শোনার অপেক্ষা আর শেষ হয় না।
“যখন তারা দস্যুদের হাতে আটক হয় তখন বলেছিল, ২০-২৫ দিনের খাবার আছে। আর ২০০ মেট্রিকটন পানি আছে। এতদিন কী খাবার আছে?”
মধুখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন আহমেদ অনীক বলেন, “একটা পরিবারের ছেলে নিখোঁজ থাকলে তাদের তো আসলে তাদের ঈদ বলতে কিছু থাকে না। তারপরও আমরা তাদের পাশে রয়েছি, স্থানীয়ভাবে যা সহযোগিতা দরকার আমরা দিতে প্রস্তুত আছি।”
জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, “সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মিদের মধ্যে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর এলাকার এক যুবক আছে। বিষয়টা আমরা জানার পরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এছাড়া অপহৃত সব নাবিককে মুক্তির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর রয়েছে।”
তারেকুলের পরিবারের মতই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের মো. আনোয়ারুল হক রাজু (২৭) ও চাটখিল উপজেলার সিংবাহুড়া গ্রামের আহমদের মোহাম্মদ সালেহর (৪৩) পরিবারেও নেই ঈদ উৎসবের কোনো প্রস্তুতি।
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের এ দুই নাবিককের পরিবারে নতুন পোশাক কেনার ধুম নেই; নেই ভালো কিছু রান্নার প্রস্তুতিও। কেবলই প্রিয়জনের মুক্তির আকুতি জানাচ্ছেন স্বজনরা।
প্রতিবেশীরা জানান, আজিজুল হক মাস্টার ও দৌলত আরা বেগম দম্পতির ছেলে রাজু এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের এবিল সি-ম্যান (নাবিক)। দুই ভাই-এক বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। গত বছর নভেম্বরের শেষের দিকে সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজে ওঠেন রাজু।
রাজুর বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে বাড়িতে নতুন ঘর তৈরির কাজ চলছে। যাকে ঘিরে এত আয়োজন সে-ই আজ বন্দি। প্রিয় মানুষটিকে ছাড়া ঈদ উদযাপনের কথা ভাবতেও পারছে না পরিবারের সদস্যরা।
রাজুর বাবা আজিজুল হক ছেলের চিন্তায় ব্যাকুল; তবুও নিজেকে সামলে রেখেছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঈদ বলতে আমাদের কাছে এখন কিছু নেই। যতদিন পর্যন্ত আমাদের ছেলে আমাদের কাছে ফিরে না আসবে, ততদিন আমরা দুঃখের মধ্যেই দিননিপাত করব।”
ঈদের সকালে কথা হয় হয় রাজুর মা দৌলত আরা বেগমের সঙ্গে। ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলেন, “ছেলে নাই, কিচ্ছু রান্না করি নাই। তার এক বন্ধু খাবার দিয়ে গেছে; কিন্তু মুখে উঠে না। একটু সেমাই কিনছিলাম, কিন্ত পড়েই আছে।
“আমরা ভালো নাই। আমার ছেলে আসার আগে আমরা কী করে ঈদ করব?”
রাজুর বড় ভাই জিয়াউল হক রনি বলেন, “প্রায় প্রত্যেকদিন সে ফোন করে আমাদের খবর নিত; ঈদে না থাকতে পারলেও ফোনে কথা হত। কিন্তু এবার তো তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।
“এবার আমাদের নতুন পোশাক কেনারও ইচ্ছা হয় নাই; নতুন বাজার সদাই করার কোনো আনন্দ নাই। আসলে ভাইকে ছাড়া আমাদের ঈদটাতো নিরানন্দ হয়ে গেছে।”
বোন কামরুন নাহার রুমি বলেন, “আমার ভাইটা বিপদে আছে। আমাদের কী আর অন্যান্য বারের মত ঈদের আনন্দ আছে?”
এদিকে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে নাবিক সালেহর ছোট পরিবার; তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সালেহর গত বছরের ঈদ কেটেছে কর্মস্থলে। এবার ঈদের আনন্দ তো দূরে থাক, তিন মেয়েকে নিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ স্ত্রী তানিয়া আক্তার।
তানিয়া ছোট ছোট তিন মেয়েকে নিয়ে শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন স্বামীর ফিরে আসার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কীসের ঈদ? এখন চাই আমার স্বামী ভালোমত যেন ফিরে আসে।”
সালেহ ফিরে আসার পানে তার সন্তানরা চেয়ে আছে বলে জানালেন তার চাচা মো. নুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “অন্যবার থাকলে তো বাচ্চাদের নিয়ে যায়, বাসার সামনে হাট বসে সেখান থেকে নতুন পোশাক কিনে দেয়। সামনেই ঈদগাহ; সেখানে গিয়ে নামাজ-কালাম পড়ে। এখনও বাচ্চারা ওই আশায় আছে যে, বাবা আসবে।”
‘এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান পরিবার নিয়ে থাকেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নন্দনকানন এলাকায়। সেখানে তার মা শাহানুর বেগম, ছোট ভাই আসিফ, তিন শিশু সন্তান ও স্ত্রী ফিরোজা আজমিন মিনা থাকেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ফিরোজা তিন মেয়েকে নিয়ে গেছেন বাপের বাড়ি হাটহাজারীতে। আর শাহানুর বেগমকে তার দেবর ছোট ছেলে আসিফসহ নিয়ে গেছেন চন্দনাইশের বরকলে নিজ বাড়িতে।
আতিকের ছোট ভাই আবদুল নুর খান আসিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের আনন্দ আমাদের এবার টানছে না। ভাইয়া দস্যুদের হাতে বন্দি, আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে। ভাইয়া যাতে সুস্থভাবে ফিরে আসে, পুরো রমজান জুড়েই আমরা রোজা রেখে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি।”
এবার পরিবারের সদস্যরা কেউই নতুন জামাকাপড় কেনেনি জানিয়ে তিনি বলেন, “আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই সকলের জন্য নতুন কাপড় কিনে বাসায় পাঠিয়েছেন। এবারে আমরা ঈদের কেনাকাটা করতে বাজারে যাইনি।”
আসিফ বলেন, “গত ঈদে ভাইয়া দেশে ছিল। আমরা একসঙ্গে ঈদ করেছিলাম। এবার ঈদে তার দেশে থাকার কথা ছিল না; কিন্তু না থাকলেও ঈদের যে আনন্দ সেটাতে কমতি হত না। এখন সব ছাপিয়ে আনন্দের ঈদ আমাদের জন্য এবারে আমাদের জন্য সুখকর নয়।”
সর্বশেষ গত শুক্রবারে আতিক উল্লাহ স্যাটেলাইট ফোনে জাহাজ থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন বলে তার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল।
আসিফ বলেন, “ঘরের সবার জন্য নতুন কাপড় কেনা হয়েছে কী-না ওই সময় ভাইয়া জানতে চেয়েছিলেন। নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়েও কথা হয়েছে তার সঙ্গে।
জিম্মি এক নাবিকের পরিবারের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সবারই তো আশা থাকে তাদের স্বজনরা যাতে দ্রুত জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু কখন সে সময় আসবে বা আলোচনায় কি অগ্রগতি হচ্ছে তা নিয়ে আমরা একপ্রকার অন্ধকারে।”
এ প্রসঙ্গে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দস্যুদের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি রয়েছে। কম সময়ের মধ্যে নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি।”
জাহাজ পরিচালনায় অভিজ্ঞ বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জিম্মি জাহাজের মালিকপক্ষ সঠিকপথেই আছে বলে মনে করি। চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে সময় লাগবে।”
ঈদের আগে নাবিকদের মুক্তি না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জাহাজে যারা চাকরি করে তাদের ঈদ বা অন্যান্য বিষয় বলতে কিছু থাকে না। তারা এসব বিষয় মেনে নিয়েই চাকরি করতে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও আবদুল্লাহর নাবিকেরা এবারে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ করতে পারত না।”