জলাধার দেখাশোনা করা ও মা মাছ ধরা যাবে না–এমন শর্তে স্থানীয় কার্ডধারী জেলেরা এটির ইজারা নিতে পারেন।
Published : 18 May 2023, 09:21 AM
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর প্রাকৃতিক জলাধার ও মাছের অভয়ারণ্য দখল করে বেআইনিভাবে বাঁধ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় জেলেরা বলছেন, এটি নির্মিত হলে মাছের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত জোতপাড়া কোল অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। সেইসঙ্গে বিঘ্নিত হবে মাছের প্রজনন।
জলাধারটির অবস্থান কুমারখালীর ৩ নম্বর জগন্নাথপুর ইউনিয়নের জোতপাড়ায়। জেলা প্রশাসন এটিকে ‘প্রাকৃতিক মৎস্যের অভয়ারণ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এ জলাধার স্থানীয় জেলেদের কাছে রাজস্বের বিনিময়ে ইজারা দিয়ে আসছে প্রশাসন।
মূলত জলাধার দেখাশোনা করা ও মা মাছ ধরা যাবে না–এমন শর্তে জেলেরা এটির ইজারা নেন। কেবল স্থানীয় কার্ডধারী জেলেরাই এ কোলটির ইজারা পাবেন বলে শর্ত রয়েছে। বিধি অনুযায়ী, কোনো প্রভাবশালীর পক্ষে জলাধারটির ইজারা নেওয়া সম্ভব নয়।
সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ এ জলাধারটিতে মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণ করছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লা আল বাকী বাদশা।
পানি সম্পদের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ এবং নদী কমিশন আইনের বিধিমতে, প্রাকৃতিক জলাধার, পুকুর-খাল-বিল-দীঘি-ঝর্ণা বা সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা চিহ্নিত বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসেবে গণ্য–এমন যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট কিংবা তাতে বিঘ্ন সৃষ্টির অপরাধে জড়িত ও দোষীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি-অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
কিন্তু এ আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই জলাধারে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদআব্দুল্লা আল বাকী বাদশা চেয়ারম্যান বলেন, “এই কোলের অপর পাড়ে আমার ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার ভোটার বসবাস করেন। কোলের কারণে তাদের হাট-বাজার, সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠানো, স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেকদিন ধরেই এখানে একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন ভোটাররা। সে লক্ষ্যেই এই বাঁধ দিয়ে একটা ফ্রেম তৈরি করা হচ্ছে।”
বাঁধ নির্মাণ করা হলে মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় জেলেনেতা সুলতান আহমেদ।
তিনি বলেন, “বাঁধ নির্মাণ করে অবৈধ দখলের কারণে কোলের জায়গা দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আগের তুলনায় এখন জলাধারের পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই প্রাকৃতিক মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাত জগন্নাথপুর কোলটি অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।
এরই মধ্যে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ ও এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে লিখিত দরখাস্ত দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই জেলেনেতা।
তবে বাঁধ নির্মাণের কারণে ‘জলাধারের কোনো ক্ষতি হবে না’ দাবি করে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, কোলের দুইপাড়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, জলাধারের ইজারা প্রাপ্তি বা দখলকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় প্রভাবশালী পক্ষগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এরই জের ধরে বাঁধ নির্মাণ ও মাটি ভরাটের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন তারা।
স্থানীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, জেলেদের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনেই বাঁধ নির্মাণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন জেলেরা।
বাঁধ নির্মাণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মন্ডল।
তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক জলাধারের প্রকৃতি, ধরন বা শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কেউ তার চেষ্টা করলে তাকে অবশ্যই আইন অনুযায়ী শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।”
জলাধারটির দায়িত্বে থাকা কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোছা. নাসরিন বানু বলেন, “ওই কোলের পানির প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণের সুযোগ নেই। এ ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “কোলের ইজারা পাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা আগেই শুনেছি। কিন্তু এর জের ধরে তো কেউ চাইলেই বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না।”