পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৯৫ সালের পর দেশে এই প্রথম এত গরম রেকর্ড হল।
Published : 17 Apr 2023, 06:54 PM
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তাপমাত্রার দিক দিয়ে সবার উপরে থাকা চুয়াডাঙ্গায় গরম বেড়েছে আরও। তবে উত্তাপের দিক দিয়ে জেলাটিকে ছাড়িয়ে গেল রাজশাহী ও পাবনার ঈশ্বরদী।
টানা ১৫ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলতে থাকা চুয়াডাঙ্গায় সোমবার তাপমাত্রা পাওয়া গেছে ৪২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এই মৌসুমে এই জেলায় সর্বোচ্চ।
মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পাওয়া গেছে রাজশাহীতেও। উত্তরের এই নগরে এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন এই তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি, অর্থাৎ এক দিনে বেড়েছে ২ দশমিক ১ ডিগ্রি।
অন্যদিকে পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সোমবার গোটা দেশে সর্বোচ্চ। ১৯৯৫ সালের পর দেশে এই প্রথম এত গরম রেকর্ড হল।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এমনিতেই বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস। তবে এবার সূর্য যেন আরও বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে দেশে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেখা নেই বৃষ্টির। খটখটে আকাশে নেই মেঘের লেশমাত্র। ফলে সূর্যের তেজ কমছে না এতটুকু।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে রেকর্ড ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরে এটিই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড।
পদ্মার বালুচরের তপ্ত হাওয়ায় ঈশ্বরদীতে অস্বস্তি
ঈশ্বরদী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক নাজমুল হক জানান, বেলা ৩টায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এর আগে ১৪ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার তা ছিল ৪১ ডিগ্রি।
সূর্য ওঠার পরই উপজেলার পথঘাট তেতে উঠছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুনঝরা রোদের তেজে বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে পদ্মার ধু ধু বালুচরের দিক থেকে বয়ে আসা তপ্ত হাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে মানুষ।
তবে প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে মাঠে কাজ করছে কৃষক, মানুষ ছুটছে ঈদের বাজারেও।
উপজেলা সদরের স্টেশন রোডে কাজ করছিলেন কয়েক শ্রমিক। বেলা ১টার দিকে তারা পৌরসভার পানির লাইনের একটি পাইপে হাতমুখ ধুচ্ছিলেন।
আল আমিন রোজা বলে পানি পান করতে পারছিলেন না। বলেন, “রোদে সব শুকিয়ে যাচ্ছে। তবু পেটের তাগিদে কাজ করতে হচ্ছে।”
পাবনা শহরের রাধানগর এলাকায় মাথায় ছাতা বেঁধে ভ্যানে করে কাপড় ফেরি করে বিক্রি করছিলেন রিয়াদ হোসেন। তিনি বলেন, “খুব রোদ উঠেছে। মাঝে মধ্যে ক্রেতা পেলে গাছতলায় জিরিয়ে নিই। তবে বিক্রি কম।”
ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ হেলাল উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এবারের গরমে ভিন্নমাত্রা রয়েছে। বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তাপদাহের মধ্যে ঠোট শুকিয়ে ও ফেটে যাচ্ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে।”
ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসমা খান জানান, তীব্র খরতাপে কেনাকাটা করতে আসা নারীদের অনেক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
প্রয়োজন ছাড়া এই সময় বাসা থেকে বের না হওয়া, পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে রাখা এবং বেশি বেশি তরল খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। শিশু ও প্রবীণদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার তাগিদও দিয়েছেন তিনি।
দুই সপ্তাহ ধরেই উত্তাপ বাড়ছে রাজশাহীতে
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ৪ এপ্রিল থেকে মূলত রাজশাহীতে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এইদিন রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পর তাপমাত্রা বড়তে থাকে। গত ১৩ এপ্রিল সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ ডিগ্রি ৬ দশমিক সেলসিয়াসে।
“সোমবার বিকেল ৩টায় রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে বেলা ১২টায় পাওয়া যায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি, একটায় ছিল ৪২ ডিগ্রি।
এদিন শহরটিতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ২৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকেল ৩টায় রাজশাহীতে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৮ শতাংশ।
টানা এই তাপপ্রবাহে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ছেদ ঘটেছে স্বাভাবিক কাজকর্মেও। বিশেষ করে পথে-ঘাটে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
তবে রুটি-রুজির তাগিদে আগুনমুখো আবহাওয়া উপেক্ষা করেই তাদেরকে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে।
বাড়ছে অসুস্থতা, আম-লিচুতে সেচের পরামর্শ
দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা তাপদাহ চুয়াডাঙ্গাবাসীর জীবনকে দুর্বিষহ হয়ে তুলেছে। সকাল ৯টার পরই তাপমাত্রা ছাড়াচ্ছে ৩০ ডিগ্রি।
তীব্র রোদ-গরমে মানুষ স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছে না। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেড়েছে।
তীব্র রোদে আম-লিচু এবং মাঠে থাকা বিভিন্ন ফসলেরও ক্ষতি হচ্ছে।
মার্চের শেষের সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল জেলায়। এরপর আকাশ মেঘলা ছিল কিছু দিন। ২ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তাপমাত্রার ‘বাড়াবাড়ি’।
সেদিন থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১৫ দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পাওয়া যায়। এই পরিবেশে বিশেষ করে দিনমজুরদের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় কষ্ট। রোদ-গরমে কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
অনেকে এই পরিবেশে কাজ করতে রাজি না থাকায় দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। অনেক কৃষক মাঠে থাকা ফসল ভালোভাবে পরিচর্যা করতে পারছেন না।
রোদে গুটি আম ও লিচু ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। বোরো ধানের মাঠে বেড়ে গেছে সেচ খরচ।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের জেলা শাখার উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, “আম ও লিচুর ক্ষতি ঠেকানোর জন্য সেচ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গাছে পানি ও ওষুধ স্প্রে করতে বলা হয়েছে। তারপরও তীব্র রোদ-গরমে আম লিচু ও বোরো ধানের কিছুটা ক্ষতি হবে।”
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ জামিনুর রহমান বলেন, “২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাঝের আট বছরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে ওঠেনি।”
আরও কয়েকদিন এ অবস্থা থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “এপ্রিলের ২২-২৩ তারিখের দিকে তাপমাত্রা কমে আসতে পারে।”