ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের এনডিসি মিলন চাকমা বলেন, “এমন ঘটনার সাক্ষী আমাদের এর আগে হতে হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের হার না মানা অভিযানে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে।”
Published : 04 Jul 2023, 10:04 AM
ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সাড়ে ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে তেলের ট্যাঙ্কার সাগর নন্দিনী-২ এর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তৃতীয় দিনের উদ্ধার অভিযানে নিখোঁজদের সবগুলো মরদেহ উদ্ধার শেষে যখন উদ্ধার অভিযান বন্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, তখন আবারও বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো শহর।
তেলবাহী জাহাজ সাগর নন্দিনী-২ এ দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এসময় প্রাণ রক্ষায় নদীতে লাফিয়ে পড়েন পুলিশ ও তেলের ট্যাঙ্কারের কর্মীরা। তাদের মধ্যে ২ পুলিশ সদস্যসহ ১৪ জন দগ্ধ হন।
এদিকে দাউদাউ আগুন বাড়তেই থাকে। বরিশাল বিভাগে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হয় ফায়ার সার্ভিসের জাহাজ অগ্নিযোদ্ধা।
প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাদের শ্বাসরুদ্ধকর চেষ্টায় মঙ্গলবার ভোর ৫টায় ট্যাঙ্কারের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের এনডিসি মিলন চাকমা বলেন, “এমন ঘটনার সাক্ষী আমাদের এর আগে হতে হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের হার না মানা অভিযানে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে।”
এদিকে নদীর মধ্যে জ্বলন্ত ওই জাহাজ সুগন্ধা পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি করে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যান বিপদের আশঙ্কায়।
দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণে দগ্ধ এক পুলিশ সদস্যসহ দুই জনকে রাতেই ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিউটে নেওয়া হয়।
তারা হলেন, পুলিশ সদস্য শওকত জামিল (২৩) এবং শরিফ (৩৫)। তাদের মধ্যে জামিলের শরীরের ৬ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে, সাথে কণ্ঠনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর শরিফের ৭ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে বলে বার্ন ইনিস্টিউটের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।
ঈদের দিন বৃহস্পতিবার সাগর নন্দিনী-২ ট্যাংকারটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর পাড়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানির জন্য জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। ১১ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে সেটি নোঙ্গর করা ছিল রাজাপুর গ্রামের কাছে।
শনিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটের দিকে হঠাৎ করেই ট্যাংকারটিতে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। এতে জাহাজের পাঁচজন দগ্ধ হন; নিখোঁজ ছিলেন চারজন।
তাদের মধ্যে একজনের পোড়া লাশ রোববার জাহাজের ইঞ্জিন রুমে পাওয়া যায়।
বিস্ফোরণের পর জাহাজটির একটি অংশ উড়ে গিয়ে সুগন্ধা নদীতে পড়েছিল। সোমবার সকালে ও দুপুরে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ডের ডুবুরিরা।
ওই চারজন হলেন জাহাজের গ্রিজারম্যান আব্দুস সালাম হৃদয়, মাস্টার ইনচার্জ রুহুল আমীন খান, সুপারভাইজার মাসুদুর রহমান বেলাল এবং ড্রাইভার সারোয়ার হোসেন।
শনিবার দুর্ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনরা সুগন্ধা নদীর পাড়ে জড়ো হয়েছিলেন। মরদেহ উদ্ধারের পর স্বজনদের আহাজারী আর কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।
কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট শাফায়েত হোসেন জানান, মরদেহগুলো অনেকটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। স্বজনরা চুল, দাড়ি ও শরীরের গড়ন দেখে তাদের শনাক্ত করেন।
এদিকে ট্যাঙ্কারের ১১ লাখ লিটার জ্বালানি তেলের মধ্যে তিন দিনে ৭ লাখ লিটার সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভাড়া করা একটি নৌযানের মাধ্যমে বাকি ৪ লাখ লিটার পেট্রোল সোমবার সন্ধ্যায় সাগর নন্দিনী-২ থেকে সাগর নন্দিনী-৪ ট্যাংকারে স্থানান্তর করা হচ্ছিল। ওই সময় হঠাৎ দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণ ঘটে এবং ফের আগুন ধরে যায় জাহাজে।
এ ঘটনায় আহত সাগর নন্দিনী-৪ জাহাজের বাবুর্চি মোহাম্মদ কাইয়ুম ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, তেল সরবরাহের সাবমারসিবল গরম হয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটে বলে তার ধারণা।
“তেল তোলার সময় সাবমারসিবল আর্থিং করা লাগে। যেহেতু পাশে পেট্রোল আছে। কিন্তু এটা করে নাই। পজিটিভ-নেগেটিভ এক হইয়া এটা ব্লাস্ট হইছে।
“দ্রিম দ্রিম কইরা বিকট শব্দ হইছে। আমি তখন পেছনে ছিলাম। উঠে দেখি সামনে খালি আগুন আর আগুন। জাহাজে আগুন লাগছে দেইখা উপায় না দেইখা নদী ঝাঁপ দিলাম। পরে নৌক আইসা আমরারে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।”
তবে ওই জাহাজে আবারও কেন বিস্ফোরণ ঘটল, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে রাজি নয় ফায়ার সার্ভিস।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) তাজুল ইসলাম মঙ্গলবার সকালে সাংবাদিকদের বলেন, জাহাজের রান্নাঘর থেকে আগুন লাগতে পারে, আবার ফিটনেসের সমস্যার কারণেও এমন হতে পারে। সব বিষয় খতিয়ে দেখে বোঝা যাবে কীভাবে আগুন লাগল।
সাগর নন্দিনী-২ নামের এই জাহাজটি মাত্র ছয় মাস আগে ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে চাঁদপুরে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে যাওয়ার পথে ভোলার তুলাতুলি কাঠিরমাথা এলাকায় ডুবে গিয়েছিল। তখন কুয়াশার মধ্যে বালুবাহী একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে ট্যাংকারটির তলা ফেটে গিয়েছিল।
এর আগে, ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর সুগন্ধা নদীর একই স্থানে একই কোম্পানির সাগর নন্দিনী-৩ জাহাজটিতেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই বিস্ফোরণে পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন